টাকা পাচার নিয়ে কয়েক ছিলিম

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Fri, 20/04/2018 - 11:22pm
Categories:

এক।

বিদেশে স্থায়ী হয়ে যাওয়া বাঙালিদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগের একটি হচ্ছে তারা দেশের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকাটা দেশের বাইরে নিয়ে যান। মিথ্যে নয়। আবার অস্বাভাবিকও নয়। ধরা যাক আপনার গ্রামের বাড়ি নীলফামারী। সেখানে আপনার কিছু বিষয় সম্পত্তি রয়েছে, হয়তো নিজেই কিনেছেন কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। আপনি ঢাকায় থাকেন, সেই সম্পত্তি দেখাশোনা অথবা ভোগ করার সুযোগ আপনার নেই। আপনি নীলফামারীর সম্পত্তি বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে ঢাকায় কিছু একটা করলেন। এটি আমরা হরহামেশাই দেখি এবং কোন ধরনের প্রশ্ন জাগেনা আমাদের মনে।

যে মানুষটি দেশের বাইরে স্থায়ী হয়েছেন তাঁর ব্যাপারটাও একইরকম। তাহলে সমস্যা কোথায়! সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশের সম্পত্তি বিক্রি করে আপনি পাচ্ছেন বাংলাদেশি মুদ্রা। আপনি যেখানে থাকেন সেখানে এই মুদ্রা চলে না। আপনাকে অবশ্যই বাংলাদেশি মুদ্রাকে আপনার কাঙ্ক্ষিত মুদ্রায় পরিবর্তন করে নিতে হবে। একটি দেশের মুদ্রার বিনিময় হার নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারে সেই মুদ্রার চাহিদা এবং জোগানের উপর। অনেক বেশি মানুষ যদি দেশি মুদ্রা বিক্রি করে বিদেশি মুদ্রা কিনতে চান তাহলে বিদেশি মুদ্রার সাপেক্ষে দেশি মুদ্রার বিনিময় মূল্য পড়ে যাবে। এক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে দেশের আমদানি খাতে, কেননা বিদেশ থেকে পণ্য কিনতে প্রয়োজন বিদেশি মুদ্রার। একটি পণ্যের দাম যদি হয় একশ ডলার আর এক ডলারের বিনিময় মূল্য যদি পঞ্চাশ টাকা তাহলে সেই পণ্যটি কিনতে একজন আমদানি কারকের লাগে পাঁচ হাজার টাকা। ডলারের মূল্য বেড়ে যদি হয় একশ টাকা, তাহলে সেই একই পণ্য কিনতে আমদানিকারকের লাগবে দশ হাজার টাকা।

এবারে বিপরীত চিত্রটি দেখি। রপ্তানি খাতে কী হতে পারে? ধরা যাক বাংলাদেশে তৈরি একটি পাটের ব্যাগের দাম পঞ্চাশ টাকা। তাঁর মানে দশটি ব্যাগের দাম পাঁচশ টাকা। যখন এক ডলার সমান পঞ্চাশ টাকা, তখন দশটি বাংলাদেশি পাটের ব্যাগ কিনতে লাগে দশ ডলার। ডলারের দাম বেড়ে একশ টাকা হলে সেই দশটি ব্যাগ কিন্তু একজন বিদেশি ক্রেতা মাত্র পাঁচ ডলারেই কিনতে পারবেন। অর্থ দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশি পণ্য আগের তুলনায় আরও আকর্ষণীয় হবে বিদেশিদের কাছে।

অর্থনীতিতে এর প্রভাব কেমন?

নির্ভর করছে কয়েকটি বিষয়ের উপর।

আমদানি খাতের কথায় আসি। আমরা কী আমদানি করি? আমরা আমদানি করি ভোগ্যপণ্য এবং শিল্পের কাঁচামাল। ভোগ্য পণ্যের দাম বাড়লে ক্রেতারা কেনার পরিমাণ কমিয়ে দেবেন। অবিক্রীত পণ্য নিয়ে আমদানি কারক পড়বেন মহা সংকটে। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো মুনাফা সংকটের কারণে ব্যাবসা গুটিয়েও আনবেন। কিছু মানুষের চাকরি যাবে তাৎক্ষনিক ভাবে, কিছু মানুষ যারা বিভিন্ন ভাবে আমদানির সাথে জড়িত, ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাঁরাও।

দুই।

টাকার বিনিময় মূল্য পড়ে গেলে উপরে বর্ণিত কারণে শিল্পের কাঁচামালের দামও বেড়ে যাবে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উৎপাদক যদি দাম বাড়িয়ে দেন তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ক্রেতা। এবং পরবর্তীতে উৎপাদক নিজেই, যেহেতু ক্রেতারা কেনা কমিয়ে দেবেন। ফলশ্রুতিতে আবারও চাকরি নাশ, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এবারে দেখি কী ধরনের ভোগ্যপণ্য আমরা আমদানি করি।

আমরা আমদানি করি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যার দেশীয় উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। আমরা আমদানি করি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, আজকাল অবশ্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদা এবং জোগানের ঘাটতি ক্রমশ কমিয়ে আনছে। আমরা আমদানি করি বিলাস দ্রব্য। আমি বাংলাদেশ অর্থনীতির পরিসংখ্যান নিয়ে অবগত নই বলে খাতওয়ারি বিশ্লেষণ দিতে পারছিনা। এ জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তবে বাংলাদেশে শপিং মল এবং বিদেশি ব্র্যান্ডের খাবারের ক্রমবর্ধমান প্রসারে কিঞ্চিৎ অনুমান করতে পারি যে বিলাস দ্রব্যের আমদানিটা খুব একটা কম নয়।

শিল্পের কাঁচামালের বিষয়টা বেশ জটিল, কেননা বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের শিল্প রয়েছে। অনেক শিল্পই শ্রমঘন, যেখানে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ। আবার কিছু শিল্প পুঁজিঘন, যেখানে খুব একটা কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। শ্রমঘন শিল্পের ক্ষেত্রে টাকার মান পড়ে যাওয়ার প্রভাব একরকম, পুঁজিঘন শিল্পের জন্য আরেক রকম। এমনকি শ্রম ঘন শিল্পেও কর্মসংস্থান ও আয়ের ব্যাপারটা সরল নয়। বাংলাদেশে শিল্পের বিকাশ হয়েছে পুঁজিপতিদের কথা মাথায় রেখেই। কম মূল্যে কাঁচামাল কেনার সুফলটাও মূলত তাঁরাই পেয়ে থাকেন। আমাদের বস্ত্রশিল্পের কথাই ধরুন না, শিল্পপতিদের আয় এবং শ্রমিকদের আয়ের ক্রমবর্ধমান ফারাকের চিত্রটা রীতিমত অশ্লীল। আবারও দুঃখিত প্রয়োজনীয় উপাত্ত দিতে না পারার জন্য। তবে কিছু দিন পরপর শ্রমিক অসন্তোষ এবং আন্দোলনের যে খবর আমরা পত্রিকার পাতায় পাই তা থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়।

টাকার মূল্যের সাথে রপ্তানি খাতের সম্পর্কটিও অতোটা সরল রৈখিক নয় যতটা সাদা দৃষ্টিতে মনে হয়। টাকার মূল্য পড়ে যাওয়ার কারণে রপ্তানি যোগ্য পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায় যেমন সত্যি, তেমনি একই পরিমাণ অর্থ অর্জনের জন্য রপ্তানিকারককে অধিক পণ্য বিক্রি করতে হয়। কথা হচ্ছে, তাঁরা কি ধারে কাটবেন, নাকি ভারে? বেশি দামে কম পণ্য রপ্তানি করেও মুনাফা হয়, আবার অল্প দামে বেশি পণ্য রপ্তানি করেও মুনাফা হয়। টাকার দাম ডলারের সাপেক্ষে সময়ের সাথে পড়ছেই, আবার একইসাথে বেড়েছে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ। আমরা অনুমান করতে পারি, আমাদের রপ্তানিকারকেরা সম্ভবত ভারেই কাটছেন। অর্থাৎ রপ্তানি খাত ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে, পণ্যের উৎপাদন বাড়ছে, বাড়ছে কর্ম সংস্থান।

আমরা দুই বিপরীত মুখি চিত্র দেখতে পাচ্ছি। টাকার বিনিময় মূল্য কমার কারণে আমদানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব, অপরদিকে রপ্তানিখাতে ইতিবাচক প্রভাব।

কখনো কখনো রাষ্ট্রকে একটি পক্ষ নিতে হয়। অনেক অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকেরা আমদানি খাতকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত (1972-2003) কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরিভাবে বিদেশি মুদ্রার সাপেক্ষে টাকার বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন। ২০০৩ এর মার্চের পর থেকে তাঁরা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে নিয়েছেন। তবে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েই গিয়েছে। আপনি চাইলেই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশের বাইরে আনতে পারবেন না। এটা করা হয়েছে যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার সরবরাহ (কারণ ডলার কিনতে টাকা লাগে) লাগামহীন ভাবে বেড়ে গিয়ে টাকার মূল্যমান কমিয়ে না দেয়।

তিন।

তাই বলে কি যারা দেশের বাইরে সম্পদ কিনতে চান তাঁরা কেনেন না? কেনেন। তাঁরা অবৈধ বাজারে টাকা বিক্রি করে বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহ করে সেই মুদ্রা অবৈধ পথে বিদেশে নিয়ে আসেন। এটাকেই আমরা বলি টাকা পাচার, আসলে দেশের টাকা তো দেশেই পড়ে থাকে হৃতমূল্য হয়ে, দেশ ছেড়ে চলে আসে বিদেশি মুদ্রা। সেদিক থেকে এটা টাকা পাচার নয়, বিদেশি মুদ্রা পাচার, মূলত ডলার পাচার।

অন্যদিকে বাংলাদেশের যে সমস্ত পেশাজীবীরা বিদেশে কর্মরত রয়েছেন তাঁরা তাঁদের উপার্জিত বিদেশি মুদ্রা দেশের রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠাচ্ছেন। এক্ষেত্রে টাকা এবং বিদেশি মুদ্রা দুইই দেশের ভেতরেই থাকছে। আপনার অর্জিত মুদ্রা যাচ্ছে দেশের ব্যাংকে আর বিনিময়ে আপনার পরিবারের সদস্যরা পাচ্ছেন টাকা। বিদেশি মুদ্রা আসছে রপ্তানি থেকে, আসছে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে, আসছে বৈদেশিক সাহায্য থেকে (এর পরিমাণ বহুলাংশে কমে এসেছে) ।

নিয়ম তান্ত্রিক ভাবে দেশ থেকে ডলার বেরিয়ে যাচ্ছে আমদানির প্রয়োজনে কিংবা দেশে কাজ করা বিদেশিদের শ্রমের মূল্য চোকানোর দায়ে। সেইসাথে নিয়ম তান্ত্রিক ভাবে দেশে আসছে বিদেশি মুদ্রা। অনিয়মতান্ত্রিক মুদ্রা পাচার এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। পত্রিকাআলারা সোজা বাংলায় বলেন “শ্রমিকের রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে উপার্জিত বিদেশি মুদ্রা একদল অমানুষের হাত ধরে বিদেশে চলে আসছে। এই অমানুষেরা আত্ম প্রেমিক, দেশ প্রেমিক নন”।

দেশ থেকে বিদেশি মুদ্রা বেরিয়ে যাবার পদ্ধতি গুলোতো দেখলাম। মুদ্রা পাচারকে যত বড় করে দেখা হয়, তত বড় করে দেখা হয় না নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরিমাণ। বলা হয়না শ্রমিকের কষ্টার্জিত বিদেশি মুদ্রা দিয়ে কয়টি বিএমডব্লিউ কেনা হচ্ছে তার কথা। বলা হয় না কয়টি নান্দোসের সসের বোতল আসছে কন্টেইনার বোঝাই হয়ে। এমন উদাহরণের অভাব নেই।

মুশকিলটা হয় যখন দেশের বাইরে যারা থাকেন তাঁদেরকে স্রেফ বাইরে থাকার কারণেই দেশপ্রেমিক না ভাবা হয়। আবীর দেশে ফিরে এসে তিন চারটা মার্সিডিজ হাঁকালে দেশ প্রেমিক, আর একই পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে বিদেশে পাচার করে ফ্ল্যাট কিনলে দেশপ্রেমিক নয় এইটে খুব বড় একটা অসংগতি। দুটো ক্ষেত্রেই দেশ থেকে বিদেশি মুদ্রা বেরিয়ে যাছে।

******বেলায়েত


Comments

হিমু's picture

Quote:
আবীর দেশে ফিরে এসে তিন চারটা মার্সিডিজ হাঁকালে দেশ প্রেমিক, আর একই পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে বিদেশে পাচার করে ফ্ল্যাট কিনলে দেশপ্রেমিক নয় এইটে খুব বড় একটা অসংগতি।

তিন-চারটা মার্সিডিজ কিনলে আপনি সরকারকে আমদানি শুল্ক দিচ্ছেন, দেশে মার্সিডিজের পাইকার আর মার্সিডিজের অনুমোদিত কারিগরকে ব্যবসা দিচ্ছেন, অর্থনীতিতে মার্সিডিজের দামের কয়েকগুণ টাকা ঘুরপাক খাচ্ছে তখন। অনিয়মতান্ত্রিক পাচারে সেটা ঘটছে না। অসঙ্গতি আছে, তবে খুব বড় নয়। বড় অসঙ্গতি থাকলে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ চাওয়াও অনুচিত, কারণ বিনিয়োগের টাকা লাভসহ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

অতিথি লেখক's picture

পড়ার জন্য ধন্যবাদ। সরকারের শুল্ক অর্জন এবং দেশীয় পাইকার আর কারিগরদের ব্যাবসা থেকে তৈরি হওয়া মাল্টিপ্লাইয়ার ইফেক্টটা অমন সরলরৈখিক নয় যতটা আপনি বলছেন।বিদেশি বিনিয়োগেরও অনেক রকমফের রয়েছে, আছে নানবিধ হিসাব নিকাশ। অসংগতিটা আসলে বেশ বড়ই। অবশ্য আমি নিজেও এই লেখাটা সরলরৈখিক ভাবেই লিখেছি। তাত্ত্বিক দিক থেকে বিষয়টি আলোচনা করতে গেলে বেশ জটিল হয়ে যাবে। তাছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতি সংক্রান্ত তথ্য তেমন একটা নেই আমার কাছে। ভবিষ্যতে কোন একদিন, হাতে তথ্য এলে, সময় করতে পারলে, সর্বোপরি তত্ত্বের কচকচানি থেকে বেরিয়ে সহজ করে লিখতে পারার দক্ষতা অর্জন করতে পারলে এই নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রয়েছে।

****বেলায়েত

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

গুড জব! আপনার কাছ থেকে নিয়মিত লেখা আশা করছি, বেলায়েত!

আপনার কয়েক ছিলিমে আমার দুই পয়সা।

১। আমাদের দেশের রপ্তানী দ্রব্যগুলোর কাঁচামাল মূলত দেশের বাইরে থেকে আসে। অর্থাৎ আমাদের রপ্তানী আয়ের সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা কাঁচামাল কেনায় চলে যায়। নীট আয় যেটা হয় সেটা স্থানীয় মূল্য সংযোজন বাবদ মাত্র। রপ্তানী দ্রব্য মাইনাস আমদানীকৃত কাঁচামাল বাবদ আয়ের একটা বড় অংশ ট্রানসপোর্ট, লজিস্টিক, ইনসপেকশন, সার্টিফিকেশন ইত্যাদি খাতে ব্যয়িত হয় ঐ বৈদেশিক মুদ্রাতেই। নীট রপ্তানী আয়ের এই শুভঙ্করের ফাঁকিটি ধনী রপ্তানীকারক শ্রেণী এবং তাদের অনুগ্রহভাজন নেতারা কখনোই বলেন না। বরং এই ফাঁপানো রপ্তানী আয়ের দোহাই দিয়ে তারা আমদানী শুল্ক-করাদি, রপ্তানী শুল্ক-করাদি, আয়কর, মূল্য সংযোজন কর ইত্যাদি থেকে রেয়াত পেয়ে থাকেন। এতে রাষ্ট্রের যে পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হয় সে পরিমাণ উপরোক্ত নীট রপ্তানী আয় থেকে বাদ দিলে বিয়োগফল একটা ঋণাত্বক সংখ্যা হবে। এর বাইরে রপ্তানী ঋণপত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং, কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানী ঋণপত্রে ওভার ইনভয়েসিং ইত্যাদির মাধ্যমে থোক টাকা পাচার তো আছেই।

২। উপরের ১ নং পয়েন্টে বলা নীট রপ্তানী আয়ের চেয়ে ঢেড় বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় প্রবাসী শ্রমিকদের আয় থেকে। সেখানে এতোসব ফাঁকির ব্যাপার নেই। অথচ প্রবাসী শ্রমিকরা ঐসব শক্তিশালী রপ্তানীকারকদের তুলনায় শুল্ক-করে তেমন কোন সুবিধা পান না। তারপরেও প্রবাসী শ্রমিকদের আয় হতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে পাচার হয়। সেটা কীভাবে? আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর অত্যধিক ব্যয় ও জটিলতার জন্য প্রবাসী শ্রমিকরা টাকা পাঠাতে হুন্ডির আশ্রয় নেন। এই হুন্ডি ব্যবসা আমদানী ব্যবসায়ের আন্ডার ইনভয়েসের টাকা পরিশোধে ব্যয়িত হয়। ফলে একেতো রেমিট্যান্স আয় হ্রাস পেলো তার ওপর আমদানী শুল্ক-করাদি থেকে প্রাপ্তব্য রাজস্ব আয়ও হ্রাস পেলো। মূল পোস্টে বলা বাংলাদেশের জমি/বাড়ি বিক্রি করে টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই হুন্ডি পদ্ধতিই ব্যবহৃত হয়। দেশের আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে দেশের টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ কি অসঙ্গত হয়? যে সব রপ্তানীকারক রপ্তানী ঋণপত্রে আন্ডার ইনভয়েসের ব্যবস্থা করে তারা তাদের অবশিষ্ট আয়টুকু বিদেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গ্রহন করে থাকে। দেশের ভেতরে চলা প্রচুর কর্মকাণ্ডের ঘুষের টাকাও আজকাল দেশের বাইরের অ্যাকাউন্টে গ্রহন করা হয়ে থাকে। এর প্রত্যেকটাতে দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়।

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে দশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয় বলে মিডিয়াগুলোতে শোনা যায়। কোন সরকার এই বিরাট অংকটা স্বীকার করে না। কিন্তু কোন সরকারই আসলে কত টাকা পাচার হয়েছে তার হিসাব দেয় না। ফলে জনগণ মিডিয়া আর সরকারের মধ্যে কে সঠিক সেটা বুঝে উঠতে পারেন না। তবে জনগণ এইটুকু বোঝেন যে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। টাকা কীভাবে যাচ্ছে সেটা কমবেশি সবাই জানেন, তবে এসব বন্ধের কোন উদ্যোগ দৃশ্যত দেখা যায় না। কেন দেখা যায় না সেটাও সবাই আঁচ করতে পারেন, তাই কেউ কিছু বলেন না। এগুলো নিয়ে আমরা কেবল আলোচনাই করতে পারবো, কিন্তু কোন ফল দেখতে পাবো না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক's picture

আপনার মন্তব্য আমার পছন্দ হয়েছে ষষ্ঠ পাণ্ডব। মূল সমস্যার দিকেই ইংগিত করেছেন আপনি। ক্যাপিটাল ফ্লাইট উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য খুব বড় একটা সমস্যা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সমস্যাটির সমাধানের চেষ্টা করা হয় গায়ের জোরে। কিন্তু আখেরে এটি মোটেই ফলদায়ক নয়। পানির ধর্ম যেমন নিচের দিকে গড়ানো, পুঁজির ধর্মও তেমন মুনাফার দিকে ধাবিত হওয়া। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পুঁজিলব্ধ মুনাফা উন্নত দেশগুলোর চাইতে বাংলাদেশে বেশি হবার কথা। তার উপর আমাদের রয়েছে ষোল/সতেরো কোটি জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল বাজার। সব মিলিয়ে এদেশে পুঁজি বিকশিত হবে এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশ থেকে পুঁজি আশঙ্কাজনক ভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসার অভাব নয়। বানের দেশে কী আর হবে গন্ধরাজের প্রেমে!

বাংলাদেশে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক ধরনের ঝুঁকির কথা আমরা ভাবতে পারি। মোটা দাগে এগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত রাজনৈতিক ঝুঁকি, দ্বিতীয়ত অর্থনৈতিক ঝুঁকি। এই দুটি আবার পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই যে এতো দুর্নীতি, এতো এতো লালফিতের ছড়াছড়ি, এইসবকিছুর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আমরা এখনো প্রতিনিধিত্বশীল একটি ব্যাবস্থা দাঁড় করাতে পারিনি। বিনিয়োগের প্রতি মানুষের আস্থা কমে গিয়েছে, তা সে ব্যাবসা, শিল্প কিংবা স্থাবর সম্পত্তি যাই হোক না কেন। মানুষ দেশের বাইরে পুঁজি স্থানান্তরকেই নিরাপদ ভাবেন আজকাল। যাদের উপায় নেই তাঁরা কষ্টে আছেন। যারা সক্ষম তাঁরা পুঁজি পাঠিয়ে দিচ্ছেন দেশের বাইরে। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে যেহেতু পাঠানোর খুব একটা সুযোগ নেই (পুঁজির যাওয়া আসা দারুণ ভাবে নিয়ন্ত্রিত এদেশে), মানুষ অনিয়মকেই আঁকড়ে ধরেছে ব্যাপক ভাবে। যে কারণেই, হুন্ডি, ওভার ইনভয়েসিং এবং এইধরনের আরও অনেক দুই নম্বুরি প্রকল্প আমরা দেখতে পাই। আইন করে কি আর এটাকে থামানো যায়! নাকি গিয়েছে? ঝুঁকি যত বাড়বে, রিস্ক প্রিমিয়াম বাড়বে তার সাথে পাল্লা দিয়ে। যার আবশ্যম্ভাবি পরিণতি ক্যাপিটাল ফ্লাইট। ক্যাপিটাল ফ্লাইট আবার সামস্টিক অর্থনীতির ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয় বহুগণ। পরিণতি আবারও ক্যাপিটাল ফ্লাইট। এই দুষ্ট চক্র চলতেই থাকে যতদিন না মূল সমস্যাগুলোর সমাধান না হয়। অতঃপর,

সব পাখি ঘরে আসে / সব নদী হারায় এ জীবনের সমস্ত লেনদেন / থাকে শুধু অন্ধকার / মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

ষষ্ঠ পাণ্ডব, আমরা কি তিমির বিলাসী!

****বেলায়েত

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

প্রশ্নটা যদি এভাবে করি — বাংলাদেশে কেন পুঁজিবাদ বিকশিত হয় না অথবা বুর্জোয়াঁ গণতান্ত্রিক বিপ্লব হয় না? অথবা যদি বলি — স্বাধীন বাংলাদেশে কেন, পাকিস্তান বা ব্রিটিশ আমলেও কেন পূর্ববঙ্গে কোন বাঙালী শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুই প্রজন্মের অধিক সময় ধরে ক্রমবর্ধমান হয় না? কেন এদেশে তিনশ’ চারশ’ বছরের পুরনো বাঙালী শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই? কেন এদেশে পুঁজির বিকাশ হয় না; বিনিয়োগ, পুনর্বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় না?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কেবল অর্থনীতি, তদসংক্রান্ত আইন-কানুন, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিতে খুঁজলে হবে না। এদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভূগোল, জলবায়ু, এদেশের মানুষের সংস্কৃতি, জীবনদর্শন — এমনসব বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিলে সঠিক উত্তরে পৌঁছানো যাবে না।

এই বিশদ আলোচনাটা আমার কর্ম নয়। বাংলাদেশে এগুলো যারা জানেন, বোঝেন তারা এগুলো নিয়ে কথায় বা লেখায় সরব নন। যাদের হাতে কিছু করার উপায় আছে তারা যা করেন তা জেনেবুঝে উল্টোটা করার মতো। এই দেখুন না, মানুষের ভরসার জায়গা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেমন হাতে ধরে শেষ করে দেয়া হলো।

একটি বিশাল অভ্যন্তরীন বাজার থাকলে দেশীয় শিল্প কীভাবে বিকশিত হয় সেটা জাপান, চীন ও ভারতকে দেখলে বোঝা যায়। বাংলাদেশে সেটা হতে পারেনি কয়েকটি কারণে —

(ক) এদেশের শিল্পগুলি একটা ইউনিটে সাপ্লাই চেনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো অপারেশনটা একাই চালাতে চায়। শিল্পটি এই প্রকার হলে তাতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করতে হয়, কয়েক দশক ধরে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হয়, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ধাক্কা সামলানোর সক্ষমতা থাকতে হয়, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ধাক্কা সামলানোর সক্ষমতা থাকতে হয়। এগুলো করা সম্ভব হয় না বলে খুব দ্রুত শিল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। অথচ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠলে এর অনেকগুলো অনায়াসে সামাল দেয়া যেতো।

(খ) এদেশের মানুষের কাছে ‘দেশীয় পণ্য মানে খারাপ, বিদেশী পণ্য মানে ভালো’ — এমনটা হওয়ায় গুণগত মানে উন্নত দেশীয় পণ্য নিম্নমানের বিদেশী পণ্যের কাছে মার খেয়ে গেছে। এই সংস্কৃতি পরিবর্তনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয় না।

(গ) এদেশে গবেষণার কোন বালাই নেই বলে আগামীকাল ভোক্তা কী ব্যবহার করতে চান বা আজকের পণ্যে কী পরিবর্তন চান, সারা দুনিয়ায় চলা প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে আগামীকাল এই দেশে কী ধাক্কা আসতে পারে এগুলো সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা থাকে না, চিন্তাও থাকে না। ফলে পরিবর্তিত দুনিয়ার পণ্য হুড়হুড় করে দেশের বাজারে ঢুকে পরে আর দেশীয় শিল্প বাতিল মাল নিয়ে বসে থাকে।

জাতীয় বাজারের আকার বড় হলে আন্তর্জাতিক বাজারে বার্গেইনিং পাওয়ার বাড়ার কথা, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারেই উলটো। আমাদের মেরুদণ্ড নরম রাবারের তৈরি বলে বাণিজ্যিক ক্রয়ের ক্ষেত্রে আমরা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে কম দামী জিনিস কিনি। আমাদের নৈতিকতার লেভেল ‘সেই রকম’ বলে প্রাতিষ্ঠানিক ক্রয়ের ক্ষেত্রে দুই টাকা ঘুষ খেয়ে দশ টাকা দামের অচল জিনিস এক হাজার টাকা দিয়ে এমন বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে কিনি যেটা পণ্য সাপ্লাই দিতে না দিতে লাপাত্তা হয়ে যায়। ঘুষখোরের দল ‘বিড বন্ড’, ‘পারফরম্যান্স বন্ড’, ‘কশান মানি’ ইত্যাদি সেফটি নেটের টাকাগুলো আগেভাগেই সরবরাহকারীকে দিয়ে দেয়।

শুনতে যেমনই শোনাক, বাংলাদেশ ব্যবসায়ে দেশী বা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য বান্ধব দেশ নয়। দেশে এমন ভ্যাট আইন করা হয়েছে যেটার সাপেক্ষে ‘ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি’র হিসাবকে দুইয়ের নামতার মতো সহজ জিনিস বলে মনে হবে। ফলে ব্যবসায়ীকে ভ্যাট অফিসের কাছ থেকে নিয়মিত নোটিশ পেতে হয়। আপনি যেভাবেই আয়করের হিসাব (স্বনির্ধারনী, সাধারণ ইত্যাদি) জমা দিন না কেন রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা তাদের নিজেদের মতো করে কর হিসাব করবেন। তারা ধরে নেবেন আপনার নূন্যতম নীট লাভ ২০%, আপনার চলতি বছরের মোট বিক্রয় ও লাভ কোনভাবেই আগের বছরের থেকে কম হতে পারবেনা – এই প্রকার আরও অনেক কিছু। ফলে চলতি বছর থেকে শুরু করে ছয় বছর আগের পর্যন্ত আপনার ট্যাক্স ফাইল নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া চলবে। একটা পর্যায়ে আপনার মনে হবে আপনি ব্যবসাটা করবেন কখন আর ট্যাক্স-ভ্যাট অফিস সামলাবেন কখন। এই ব্যাপারে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের আসলে দোষারোপ করার উপায় কম। ঊচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক সরকার যখন জনতুষ্টির লক্ষ্যে বিরাট আকারের বাজেট দেয় তখন তার আয়ের যোগানের জন্য রাজস্ব বিভাগের উপর স্টিমরোলার চলে যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ওপর এই চাপ। একই সাথে স্থানীয় ঊচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাড়তি চাহিদা মেটানোর দায় ব্যবসায়ীদের ওপর চাপে বলে তারা ঘরেও মরেন, বাইরেও মরেন।

২০০৭-২০০৮ সালের ছদ্ম সামরিক শাসনামলে দুর্নীতি দমন কমিশন, গুরুতর অপরাধ দমন জাতীয় কমিটি, হঠাৎ গ্রেফতার ইত্যাদির তৎপরতায় দেশের অর্থনীতিতে একটা স্থায়ী পরিবর্তন এসেছে। আগে ঘুষখোর, কালোবাজারী, চোরাচালানী, করফাঁকিবাজ, লুটেরারা তাদের অবৈধ আয়ের একটা অংশ দেশে বিনিয়োগ করতো, আর এখন কারো কালো টাকার পরিমাণ দুই কোটি টাকা হোক আর দুই হাজার কোটি টাকা হোক তার সবই দেশের বাইরে পাচার করে দেয়।

অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, কানাডা থেকে শুরু করে মাল্টা, সাইপ্রাস ইত্যাদি দেশে বিনিয়োগ, জমি/বাড়ি কেনা, পিআর/নাগরিকত্ব নেয়া, রিটায়ার হোম/সেকেন্ড হোম ইত্যাদির বিজ্ঞাপন সব মিডিয়ায় চলে; পাঁচ তারকা হোটেল ভাড়া করে এই বিষয়ক সেমিনার করা হয়; আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে এর ওপর মেলা হয় — সবাই সব কিছু দেখেন, শোনেন, বোঝেন তবু কেউ কিছু করেন না।

এখনকার পৃথিবীতে কাউকে মরতে দেয়া হয় না। ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেয়া হয়। সেই সুযোগ নিতে না চাইলে তাকে ঘাড়ে ধরে সে সুযোগ নিতে বাধ্য করা হয়। নয়তো তার হাড়-মাস নিংড়ে রস বের করে নেবে কী করে!

এই দেশটার জন্য মায়া আছে এমন মানুষেরা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ's picture

আপনার কাছ থেকে এরকম আরও লেখার আশা করছি, বেলায়েত।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিওআই এর (বোর্ড অভ ইনভেস্টমেন্ট) ওয়েব সাইটে এই সংক্রান্ত প্রচুর তথ্য উপাত্ত পাবেন, যদিও প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে...।
খুব ইচ্ছে হয় দেশের অর্থনীতি নিয়ে নিরপেক্ষ আলোচনা/কিংবা মতামত পড়তে, কিন্তু তেমনটি দেখিনা। কয়দিন আগে মিডিয়াতে ব্যাঙ্কিং সেক্টরে ‘তারল্যের অভাব’ নিয়ে খুব হৈচৈ হল। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ৬-৯ মাস আগেও ব্যাঙ্কিং সেক্টরে অতিরিক্ত তারল্য ছিল এমন তথ্য দেখা যায়। কেউই রেকোনসাইল করল না। মধ্যে থেকে ব্যাংকিং খাতের লোকজন দুটো সুবিধা আদায় করে নিল সরকারের কাছ থেকে...।
যাই হোক। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দেশের বাইরে টাকা পাঠানো আর অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ‘পাচার’ কে আমি কোনভাবেই এক পাল্লায় মাপব না। এবং এই পাচার নিয়ে হৈহৈ হওয়া উচিত বলে মনে করি। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দেশের বাইরে টাকা পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠিন জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে... এবং একধরণের নিয়ন্ত্রণ আছে।
পাণ্ডবদার সাথে এক/দুই নিয়ে প্রচন্ড একমত। তবে নীট রপ্তানী আয়ের ব্যাপারটা মূলত গার্মেন্ট সেক্টারে প্রযোজ্য।
অবশ্য সবকিছুই দৃষ্টিকোণের ব্যাপার। আমি বিদেশি বিনিয়োগের পক্ষে (হিমুর কিছুটা আপত্তি দেখলাম) - কর্ম সংস্থান এবং সরকারের রাজস্বে বড় ভুমিকা রাখে। টেলিকম সেক্টারে নিজে থেকে এর প্রভাব দেখেছি। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে লাভ্যাংশ নিয়ে যাওয়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ এবং বিধিনিষেধ আছে।

হিমু's picture

Quote:
আমি বিদেশি বিনিয়োগের পক্ষে (হিমুর কিছুটা আপত্তি দেখলাম)

বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আমার আপত্তি নেই। লেখক যেটাকে "বড় অসঙ্গতি" বলছেন (দেশে বিলাসকে উনি বিদেশে পাচারের সাথে সমান পাল্লায় তুলতে চান, তুলতে না দিলে সেটা অসঙ্গতি বলছেন), সেটা মেনে নিলে বাই দ‍্য সেইম টোকেন বিনিয়োগ চাওয়ার অবস্থান থেকেও সরে আসতে হয়, সেটা বলেছি।

নৈষাদ's picture

ঠিক আছে, আমি কিছুটা ভুল বুঝেছি।
দেশে বিলাস পণ্যের ব্যাপারে সহমত। বাংলাদেশে কিন্তু ২০০০ সিসির উপর গাড়িতে শুল্ক ইত্যাদি বাবদ সরকারকে দিতে হয় মূল্যের ৪০০%। মালটিপ্লায়ার এফেক্ট বাদ দিলেও।

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

ব্যাংকিং খাতে যা হচ্ছে বস্‌, সেটা হচ্ছে হাতে ধরে শেষ করে দেয়া। এখানে আপনি রিকনসাইল করার চেষ্টা করুন, হুইসেল ব্লোয়িং করুন, কণ্ঠ ঊচ্চ করুন, এমনকি রাজপথে আন্দোলন করুন - কিছুতে কিছু হবে না।

বাংলাদেশ থেকে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশের বাইরে টাকা পাঠানোর উপায় প্রায় নেই। তাই এখানে ছোট/বড় যা কিছু ট্রানজেকশন হয় তার বেশিরভাগ অবৈধ উপায়ে। বাংলাদেশে এফডিআই-গুলো থেকে লভ্যাংশ নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে সেন্ট্রাল ব্যাংকের কঠোর আইন-কানুন আছে সত্য, তবে এখানে অনেকগুলো সাইফন আছে যেগুলো দিয়ে কী করে যে টাকা চলে যায় সেটা রেগুলেটরি বডি ধরতে ধরতে ভ্রমর মধু খেয়ে চলে যায়।

নীট রপ্তানী আয়ের যে হিসাবটার কথা বলেছি সেটা শুধু গার্মেন্ট সেক্টরে নয় বস্‌। বাংলাদেশের অন্যান্য রপ্তানী খাতের মধ্যে যেগুলো বড় যেমন, (ক) পাট ও পাটজাত পণ্য (খ) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য (গ) মাছ, চিংড়িসহ সকল হিমায়িত পণ্য (ঘ) চা, তামাকসহ সকল কৃষিপণ্য (ঙ) ঔষধ - এমন সব শিল্পে বীজ, কীট/বালাই নাশক, উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট রাসায়নিকসমূহ, প্রক্রিয়াজাতকরণের যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিকসমূহ, উৎপাদনের যন্ত্রপাতি, উৎপাদন কৌশল, দক্ষ কলাকুশলী এসবের বড় অংশ নগদ বৈদেশিক মুদ্রায় কিনে আনতে হয়। রপ্তানী আয় থেকে ঐসব আমদানী ব্যয় এবং এখানেও যে পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হয় তা বাদ দিলে এর অনেকগুলোই আমাদের বহুল আলোচিত 'বোগাস ইন্ডাস্ট্রি' ছাড়া আর কিছু না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ's picture

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মকানুন কতটা কড়া, কর্মক্ষেত্রে সেটা আমার সরাসরি দেখার সুযোগ হয়েছে। এবং এটাও ঠিক যে, নতুন একটা নিয়মের সমস্যা ধরতে ধরতে লোকজন সুযোগ নিয়ে নেয়। যেটা ব্যাংকিং ক্ষেত্রে বিদেশে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে।

আমি জানতাম না অন্যন্য শিল্পেও এত বেশি বিদেশ-নির্ভরতা আছে।

কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও পুরানো সেই ‘বোগাস’ ইন্ডাস্ট্রির কথা মনে করিয়ে দিলেন। পাঠকদের জন্য – আমেরিকায় পড়াশোনা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক, যিনি আবার আবার তখনকার দিনে্র ‘বাজার অর্থনীতির’ পাড় সমর্থক ছিলেন, আশির দশকের শেষে, কিংবা নব্বইয়ের শুরুতে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, সেখানে বাংলাদেশে ‘বোগাস ইন্ডাস্ট্রি’ নামক একটা তত্ত্ব দিয়েছিলেন (যেটা আমাদের পড়তে হত)। তো একদিন ক্লাশে কিছুটা তর্ক হয়েছিল সেই শিক্ষকের সাথে (শিক্ষা-ব্যবস্থায় যেটা মোটেই গ্রহণযোগ্য ছিল না)। তর্ক করলেও কিন্তু তত্ত্বটা আগ্রহোদ্দীপক ছিল।

তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী, কাঁচামালের উপর আমদানী শুল্ক কমিয়ে (কিংবা শুন্যের কোঠায় এনে) এবং ফিনিসড প্রোডাক্টের উপর উচ্চশুল্ক ধার্য করে সরকার যে দেশীয় শিল্পকে (এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড না, দেশীয় ভোক্তাদের জন্য) রক্ষার দায়িত্ব নেয়, সেটা আসলে কোন উপকার করেনা, বরঞ্চ দেশে ‘বোগাস ইন্ডাস্ট্রি’ তৈরি করে সেই সব তথাকথিত উদ্যোক্তার পকেট ভারিতে সাহায্য করে।

মনে আছে তিনি টেলিভিশনের উদাহরণ দিয়েছিলেন, সিকেডি/এসকেডি কর্মে কাঁচামাল এবং ফিনিসড প্রোডাক্টে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। ধরি সিকেডি/এসকেডি ফর্মে কাঁচামালের উপর আমদানী শুল্ক ০-৫%, এবং ফিনিসড প্রোডাক্টের উপর ৫০% (দেশি শিল্পকে সুরক্ষা দেবার উদ্যেশ্যে)। আন্তর্জাতিক বাজারে সিকেডি/এসকেডি কর্মে দাম পরে, ধরুন ৯৫ ডলার, ফিনিসডের ১০০ ডলার। সিকেডি/এসকেডি ফর্মে এনে ‘ইন্ডাস্ট্রিতে’ ফিনিসড প্রোডাক্ট বানিয়ে, লাভ-টাভ রেখে দেশের বাজার বিক্রি করা যাচ্ছে ১৩০-১৪০ ডলারে। তাঁর কথা অনুযায়ী ভোক্তা যেখানে ১০০ টাকায় সরাসরি বিদেশি প্রোডাক্ট কিনতে পারত, সে সেখানে ১৩০-১৪০ ডলারে দেশীয় প্রডাক্ট কিনে ঠকছে। আবার সরকার যদি ৩০-৪০% শুল্ক দিয়ে সরাসরি বিদেশি প্রোডাক্ট ছাড়ত, তবে সরকারের কোষাগারে কিছু জমা হত। এরমাঝে তথাকথিত ‘ইন্ডাস্ট্রিয়েলের’ পকেটে টাকা চলে যাচ্ছ। ‘কর্ম-সংস্থান, মালটিপ্লায়ার এফেক্ট ইত্যাদি বলায়’ তিনি বলেছিলেন, রাশিয়ার মত একদল শ্রমিককে গর্ত করার দায়িত্ব এবং পরে আরেক দলকে গর্ত বন্ধের দায়িত্ব কি কর্ম-সংস্থান সৃষ্টি......।

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

১। দুইটা প্রবাদ বাক্য মনে পড়ে - 'বজ্র আঁটুনি, ফস্কা গেরো' আর 'শক্তের ভক্ত, নরমের যম'।

২। দেশে বড় আকারের প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি আছে। এই ইন্ডাস্ট্রির বড় অংশের কাজ হচ্ছে ইঞ্জেকশন মোল্ডিং মেশিনে ফুঁ দেয়া, এক্সট্রুশন মেশিনে ঠেলা দেয়া, ডাই কাস্টিং মেশিনে চাপ দেয়া ইত্যাদি - বাকি সকল কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানীকৃত।

৩। বোগাস ইন্ডাস্ট্রির বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য ধন্যবাদ। আমার দৃষ্টিতে কাঁচামালের উপর আমদানী শুল্ক কমিয়ে ফিনিসড প্রডাক্টের উপর উচ্চশুল্ক ধার্য করা ইন্ডাস্ট্রিই শুধু বোগাস নয়, কাঁচামালের ওপর আমদানী বা ফিনিশ্‌ড্‌ প্রডাক্ট ওপর রপ্তানী শুল্ক-কর নাই করে দিয়ে আয়কর নাই করে দিয়ে গড়ে তোলা ইন্ডাস্ট্রিও বোগাস ইন্ডাস্ট্রি। এখানেও কর্মসংস্থানের দোহাই দেয়া হয় যদিও সেটা কোন জোরালো যুক্তি নয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সোহেল ইমাম's picture

পড়ে ভালো লাগলো। এরকম লেখা আরো আসা উচিত। অর্থনীতির অনেক বিষয়েই দাঁত ফুটাতে পারিনা। বুড়ো দাঁতে কাটতে পারি এরকম আরো বেশ কিছু লেখা আসতে থাকুক। দেঁতো হাসি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক's picture

অনেকদিন পর কোনো লেখা নিয়ে বিস্তর আলোচনা দেখলাম(যদিও পার্টিসিপেট কম মন খারাপ, যাই হোক তাও পেলাম তো!) এমন লেখা আরো আসতে থাকুক। হে ভগবান সত্য হোক আমার এ প্রার্থনা!
-বৃদ্ধ কিশোর

নীড় সন্ধানী's picture

জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে লিখেছেন। বাইরে ছিলাম বলে দেরীতে পড়া হলো। তবু বিলম্বিত মন্তব্যটা রেখে যাই।

বাংলাদেশের রপ্তানী আয়ের বিপুল অংকটি কতটা ফাঁপা বেলুন এটা নিয়ে পাণ্ডবদা বলে দিয়েছেন। ওদিকে যাচ্ছি না তাই।

বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হয়, কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয় তার ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে।

বাংলাদেশে ১০০% রপ্তানিমূখী শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য শুল্কমুক্ত ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল ১০ বছর। এই দশ বছর ফ্রি খাওয়ার পর করের আওতায় আসার সময় হলে প্রতিষ্ঠানগুলো কর ফাঁকি দেবার জন্য বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থা গ্রহন করে। এটা একটা ইঁদুর বেড়াল খেলা। তবে ইঁদুর বেড়ালের মাঝখানে একটি দেশীয় এজেন্ট থাকে যার কাজ হচ্ছে ইঁদুর ও বেড়াল দুজনকে সন্তুষ্ট রাখা। এখানে ইঁদুর হলো রপ্তানীকারক এবং বেড়াল হলো শুল্ক কতৃপক্ষ।

দশ বছর পর্যন্ত হিসেব ঠিক আছে। নিয়ম হলো দশ বছর পার হবার পর ইঁদুরকে লাভের উপর ৪০% কর দিতে হবে। যেমন ১০০ টাকা রপ্তানী থেকে খরচপাতি বাদ দিয়ে যদি ১০ টাকা লাভ থাকে তাহলে তাকে ৪ টাকা বেড়ালকে দিতে হবে ৬ টাকা নিজের পকেটে রাখতে পারবে। কিন্তু ইঁদুর কিছুতে এই ৪ টাকা দিতে রাজী না। সে এমনভাবে হিসেব দাখিল করে যাতে মনে হয় তার লাভের পরিমান ১ টাকারও কম অথবা সে ক্ষতি স্বীকার করে ব্যবসা করছে। এই ফাঁকিটা বেড়ালও জানে। তাই আইন করলো রপ্তানী আয়ের রেমিটেন্সের উপর ৫% হারে উৎস কর দিতে হবে। এই টাকা ব্যাংকগুলো কেটে রাখে যখনই বিদেশ থেকে টাকা আসে। এই উৎস কর অবশ্য বছর শেষে সমন্বয় করা হয় ফাইনাল ব্যালেন্স শীটের লাভের সাথে। যেখানে লাভ বলতে তেমন কিছুই থাকে না। সরকার যা পায় তা ব্যাংকের এই ৫% উৎস কর। এই নিয়ম করার পর ইঁদুরও নতুন চাল চাললো। সে বাণিজ্য পদ্ধতি বদল করে ফেললো। নতুন পদ্ধতিতে বিদেশ থেকে নগদ অর্থ হিসেবে শুধু সিএম অর্থাৎ উৎপাদন খরচটা আসবে, সমস্ত কাঁচামাল আসবে ফ্রিতে। অর্থাৎ আগে যেখানে ১০০ টাকা আসতো এখন সেখানে আসবে ২০ টাকা। ব্যাংকগুলো নিয়মমাফিক ৫% কেটে রাখলে সরকারের খাতে যাবে ১ টাকা। এখন বেড়ালের কিছু করার নাই। কেননা বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির স্বার্থে সরকার এই পদ্ধতির রপ্তানী বাণিজ্য খোলা রেখেছে রপ্তানীকারকদের জন্য। এখানেও ইঁদুরের জিত। পরিসংখ্যানের হিসেবে সরকারের কাছে রপ্তানীর অংকটি ১০০ টাকা হলেও সরকার এখানে পাচ্ছে মাত্র ১ টাকা।

বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ না করলে এই ফাঁকির বিষয়টি কোনভাবে জানার উপায় নেই।

এত সুবিধা সত্ত্বেও কী সেভাবে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে বাংলাদেশে? মোটেও না। না বাড়ার কারণগুলো নিহিত অন্যন্য অবকাঠামোগত খাতে। আসলে শুল্ক সুবিধা দিয়ে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার চেয়ে যোগাযোগসহ অবকাঠামোর পেছনে ব্যয় করলে যে অনেক বেশী লাভবান হওয়া যায় তার সবচেয়ে কাছের উদাহরণ ভিয়েতনাম। বিশ বছর আগে যাদের রপ্তানী ও বিনিয়োগ আমাদের সমান সমান ছিল, অগ্রগতির পরিমান আমাদের প্রায় দশগুন। আমরা ভুল জায়গায় তেল খরচ করে এখনো উন্নয়নের বগল বাজিয়ে অনর্থক তৃপ্তির ভাণ করছি।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

হিমু's picture

Quote:
নতুন পদ্ধতিতে বিদেশ থেকে নগদ অর্থ হিসেবে শুধু সিএম অর্থাৎ উৎপাদন খরচটা আসবে, সমস্ত কাঁচামাল আসবে ফ্রিতে।

কাঁচামাল বিনামূল্যে আসে এমন শিল্পগুলোর জন্যে দ্বিগুণ হারে উৎসে কর কাটার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

কর কাটার হার দ্বিগুণ/ত্রিগুণ যাই করা হোক, বছর শেষে প্রদত্ত এআইটি বা উৎসে কর সমন্বয়ের সময় আয়কর মওকুফের বিধান যেন না থাকে। মানে, দুহিল দুধ যেন বেন্টে না ষামায়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

এফডিআই-এর রাজস্ব ফাঁকি নিয়ে চমৎকার সংযোজন বস্‌! আমি আরও এক পয়সা যোগ করি।

ধরা যাক, ইঁদুরের প্রতিষ্ঠানের নাম Sham Industries Dikshunyapur Limited। প্রতিষ্ঠানের বয়স যখন আট বছর ছুঁই ছুঁই তখন আরেকটা প্রতিষ্ঠান গড়া হলো Sham Industries Dikshunyapur Limited-2 নামে। দুই প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা এক, অথবা প্রায় এক (যথা, উপর তলা আর নিচ তলা)। এর পর প্রথম প্রতিষ্ঠান আস্তে আস্তে লোকসান দিতে থাকে; তার মেশিনপত্র, কর্মীরা দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানে যেতে থাকে। একাদশ/দ্বাদশ বছরে দেখা যায় প্রথম প্রতিষ্ঠানের খোল ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই; অচিরেই সেটি মারা যায় আর একই বিনিয়োগ নিয়ে বিনিয়োগকারী আরও বছর আষ্টেকের জন্য কর অবকাশ সুবিধা পেয়ে যায়।

গণচীনের একটা বন্দর থেকে একটা বিশফুটি কন্টেইনার চট্টগ্রামে আনতে জাহাজ ভাড়া নেবে হাজার ডলারের ওপর, আর সেটা ভারতের কোন বন্দরে নিতে লাগবে শ’পাঁচেক ডলার। কন্টেইনারটি চট্টগ্রামে আসতে সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ায় ট্রানজিটে সময় লাগবে পাঁচ থেকে পঞ্চাশ দিন, ভারতের ক্ষেত্রে ওটা সর্বোচ্চ পাঁচ দিনই। চট্টগ্রাম বন্দরের আউটার অ্যাংকোরেজ থেকে জাহাজের বার্থ নিতে এক দিন থেকে সাত দিন লাগবে, ভারতে সেটা খারাপ পরিস্থিতিতেও সর্বোচ্চ তিন দিন। ভিয়েতনামের তুলনাটা টানলাম না, তাতে হতাশাটা আরও বাড়বে। পণ্য রফতানী করার ক্ষেত্রে যে সময়সীমা থাকে তার বড় অংশ যদি কাঁচামাল আমদানীতে চলে যায় তাহলে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের জন্য আর সময়টা থাকে কোথায়!

অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন মার খেয়ে যায় ব্যাপক দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও অপেশাদারিত্বের জন্য। ব্যবসা নির্মম, নিষ্ঠুর, দক্ষ পেশাদারদের বিষয় — কলকাকলীর আসর না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.