প্রাণ কী ৭: প্রাণের আধ্যাত্মিক সংজ্ঞার পরিসর দিন দিন ছোট হয়ে আসছে

সজীব ওসমান's picture
Submitted by Shajib Osman on Tue, 20/02/2018 - 6:13am
Categories:

প্রাণ কী প্রশ্নটার আধ্যাত্মিক উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে আত্মার প্রসংগের আনয়ন ঘটে। এইভাবে সংজ্ঞায়নের সমস্যা নিয়ে এই সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে লিখেছিলাম প্রায় ৪ বছর আগে! হৃৎপিন্ডের ধুকপুকানি যদি আত্মার কাজ হয় তবে হৃৎপিন্ডহীন জীবের ক্ষেত্রে আত্মাটা কোথায় থাকে? আবার যাদের মস্তিষ্কও নাই তাদের আত্মা কী? সেজন্য হৃদস্পন্দন দিয়ে তো আর প্রাণকে বর্ণনা করা যায় না।

হৃদস্পন্দন

সেই হৃৎপিন্ডের ধুকপুকানি নিয়েই পরের গল্প। উত্তর আমেরিকার বড় বড় হাসপাতালগুলিতে গবেষণা সুবিধা থাকে, গবেষণাগার থাকে, যেখানে রোগী কেন্দ্রিক গবেষণা গড়ে তোলা যায় সহজেই। আমার গবেষণাগার থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে ম্যাসাচুসেট্স জেনারেল হাসপাতাল। এখানের একটা এমনই গবেষণাগারে সম্প্রতি একটা কার্যক্ষম, ধুকপুক করতে থাকা হৃৎপিন্ড তৈরি করেছেন কিছু বিজ্ঞানী মানুষের ত্বকের কোষ ব্যবহার করে। ত্বকের কোষকে নিধিকোষে পরিণত করার উপায় বের করেছেন বিজ্ঞানীরা মাত্র কয়েকদিন আগেই (পরের পর্বে বিস্তারিত থাকছে)। পূর্ণাঙ্গ হৃৎপিন্ড তৈরির জন্য প্রতিস্থাপনের অনুপযোগী কিছু মানুষের হৃৎপিন্ডকে নিয়ে তার সব কোষগুলিকে ঝরিয়ে ফেলা হয়েছে প্রথমে। তাতে হৃৎপিন্ডের শুধু কঙ্কালটাই থাকে এবং দেখতে লাগে এরকম -

তারপরে মানুষের ত্বকের কোষ নিয়ে তাকে বার্তাবাহক আরএনএ'র একটা পদ্ধতি দিয়ে ভ্রণায়িত নিধিকোষে পরিণত করা হয়। এইধরনের নিধিকোষকে তারপরে দেহের যেকোনরকম বিশেষায়িত কোষ, যেমন হৃদকোষে পরিণত করা চলে।

এই কোষ নিয়ে তারপরে হৃৎপিন্ডের যে কঙ্কাল বানানো হলো তার মধ্যে বৃদ্ধি করানো হয়, অর্থাৎ কঙ্কালটি একধরনের কাঠামো হিসেবে কাজ করে। এই কঙ্কালটি দরকার হয় কারন হৃৎপিন্ডের নির্দিষ্টরকম গঠন আছে যা তাকে কার্যকরভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। কঙ্কালটি সেই গঠনটি তৈরিতে কাঠামো হিসেবে কাজ করে। দুসপ্তাহ কোষ বৃদ্ধির পরে হৃৎপিন্ডটি যখন কিছুটা আসল হৃৎপিন্ডের মতোই গঠনে তৈরি হয়ে আসে তখন বৈদ্যুতিক আঘাত দিয়ে এর মধ্যে স্পন্দন তৈরি করা হয় এবং ধুকপুকানি শুরু করে দেয় এই হৃৎপিন্ড।

এখন এই উদাহরণটি দিয়ে কয়েকটি পর্যায়ে প্রাণকে দেখা চলে, সবগুলি পর্যায়ই জীবিত! এক, কোষ পর্যায়ে, দুই, কর্মক্ষম অঙ্গ বা স্পন্দিত হৃৎপিন্ডের পর্যায়ে এবং তিন, পুরো প্রাণীর পর্যায়ে। চিন্তা করে দেখুন তো, হৃৎপিন্ডহীন একটি মানুষ যেখানে জীবিত থাকতে পারেনা, সেখানে কৃত্রিমভাবে তৈরি একটি হৃৎপিন্ড বসিয়ে দিলেই প্রাণীটি প্রাণী হিসেবে কার্যক্ষম হয়ে উঠছে। আবার হৃৎপিন্ডটি নিজে প্রাণও নয়। একে বৈদ্যুতিক আঘাত দিয়ে শুধুমাত্র চঞ্চল করা চলে।

সবগুলো পর্যায়েই তো প্রাণ ছিলো, কিন্তু প্রাণী পর্যায়ে এসে তারা একসাথে সংহতভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রাকৃতিকভাবে এরকম সংহতি তৈরি হয়ে হয়ে কার্যক্ষম প্রাণীর প্রবাহ চলেছে। যাকে আমরা বিবর্তন বলি।

জলভল্লুকের জীবন

জলভল্লুক হলো একধরনের অতিক্ষুদ্রাকায় প্রাণী যারা দুনিয়ার সবচেয়ে অক্ষয় বহুকোষী প্রাণী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। এরা দেখতে এরকম -

হয়তো আপানারা ইতিমধ্যেই জানেন। এই প্রাণী যেমন পৃথিবীর পথে পথে ধুলাবালিপানিতে বসবাস করতে পারে, তেমনি এদেরকে অন্তরীক্ষে ছেড়ে দিলেও দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকতে পারে, কোন স্পেসস্যুট ছাড়াই। অর্থাৎ এরা প্রচন্ড চাপ, তাপ, বিকিরণ রশ্মি ইত্যাদি সহ্য করতে সক্ষম। অক্ষয় প্রাণীর সংজ্ঞা বলতে যা বোঝায় তাই।

আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ গুন হলো এরা নিজেদের শরীরকে পুরোপুরি শুকিয়ে ফেলতে পারে এবং কোন পানি ছাড়া প্রাণহীন অবস্থায় দশকের পর দশক বেঁচে থাকতে পারে। সবচেয়ে অদ্ভুত একটা কাহিনী হলো একটা জাদুঘরে রাখা এক উদ্ভিদ থেকে এরকম শুকিয়ে যাওয়া একটা একশ বছর আগের জলভল্লুককে পানিতে ছেড়ে দেয়ার কয়েক ঘন্টা পরেই জীবিত হয়ে উঠেছে।

শুকিয়ে থাকা অবস্থায় জলভল্লুক ডানের ছবির মতো এরকম গুটিয়ে যায়, যার সাথে একটা বালুকণার কোন পার্থক্য থাকেনা। দুটোই সমান জড়।

শুকনো অবস্থায় তাদের দেহ আর জড়পদার্থের সাথে কোন অমিল নাই। শুধু জলভল্লুকের দেহে থাকে কিছু রাসায়নিক যৌগের সমন্নিত বিন্যাস, যাকে জাগিয়ে তোলা যায় শুধু পানির স্পর্শেই! পানিও তো আত্মা নয়। প্রাণের রাসায়নিক সংজ্ঞার এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে?

কেতুকের জাদু

এক্সোলোটল নামক একধরনের কেতুকের বাস মেক্সিকোর উপকূলে। (ইংরেজী স্যালাম্যান্ডারের বাংলা নাম কেতুক করেছে ফেইসবুকে বাংলা শব্দ পেইজ। এখান থেকে দেখতে পারেন নামকরণের পেছনের গল্প। ) খুব সাধারণ চারপেয়ে উভচর প্রাণী মনে হলেও এদের একটা অদ্ভুত গুণ আছে! ডেডপুল ছায়াছবিটা দেখেছেন? দেখলে হয়তো খেয়াল করবেন ছায়াছবিতে ডেডপুল বলে এক লোকের আশ্চর্য একটা ক্ষমতা আছে। সে নিজের দেহের কোন অঙ্গকে পূর্ণজন্ম দিতে পারে, মানে আবার গজাতে পারে। কেতুক ঠিক সেটাই করতে পারে, মানে বাস্তব দুনিয়াতে।

মনে করেন কোন কারনে এদের একটা পা কেটে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। এই কেতুক তাতে কিন্তু খুব দমে যাবেনা। কারন এরা সম্পূর্ণ একটি প্রাপ্তবয়স্ক পা আবার নতুন করে তৈরি করতে পারে! পায়ের হাড়, পেশী, স্নায়ু, ত্বক ইত্যাদি সকল কিছু সহ একটা সম্পূর্ণ পা। প্রচ্ছদ ছবিতে যেমন পা গজাতে দেখছেন, তেমন।

মানুষ যেখানে দেহের কিছু ছোটখাটো কাটা কলা, চুল, ত্বক এবং নখের পুর্নজন্ম ঘটাতে পারে সেখানে এই এক্সোলোটল পুরো একটা অঙ্গ অবিকল পুর্নজন্মাতে পারে। চিন্তা করেন, মানুষ যদি এমনটা পারতো!

এই অদ্ভুত গুণের কারনে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই প্রাণীটির অসাধারণ গুরুত্ব আছে। সম্প্রতি তাদের জেনোম বিন্যাস সেজন্য বের করা হয়েছে। অদ্ভুত শোনাতে পারে, কিন্তু এই প্রাণীটির ডিএনএর দৈর্ঘ্য মানুষের ডিএনএর চেয়ে ১০ গুণ বড়। এরা দেখতে যতই আদি হোক, আমাদের চেয়ে অনেক বড় ডিএনএকে বহন করে চলেছে কোন কারনে।

জেনোম বিন্যাস থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনের প্রকাশের তারতম্যের হদিস পাওয়া গিয়েছে যা অন্যান্য প্রাণীতে দেখা যায় না। কিন্তু একদম সূক্ষভাবে বোঝার জন্য আরও অনেক গবেষনা প্রয়োজন। তাহলে কোন একদিন হয়তো আমরা নিজেদের জিনের কারিকুরি করে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া অঙ্গ, নষ্ট হওয়া প্রত্যঙ্গ ইতাদ্যিকে সারিয়ে তুলতে পারবো। পঙ্গুত্বকে বিদায় জানানোর এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে?

এবার বলি এই কেতুককে নিয়ে এতো কথা কেন বলছি। প্রাণের সাথে এর সম্পর্ক কোথায়? আছে যদি আপনি একটু চিন্তা করেন এর গুণটা নিয়ে।

হয়তো ভবিষ্যতে এমন একটা দিন আসবে যেখানে মানুষকে একদম একটা ত্বকের কোষ থেকে তৈরি করে ফেলা যাবে। আধুনিক প্রযুক্তির যে হারে উন্নতি হচ্ছে সেখানে আমি এই ঘটনা যদি আগামি ৫০ বছরের মধ্যেও ঘটে তবে অবাক হবনা। তাহলে শুধু এককোষী জীব নয়, বরং মানুষের মতো বহুকোষী জীবের আবির্ভাব ঘটবে শুধুমাত্র একটি একক কোষ থেকে। এই পদ্ধতিতে কোন আত্মার স্থান নেই।

তবে তার আগেই, অদূর ভবিষ্যতে, এখনকার জন্য মৃত্যুসম দৈহিক আঘাতগুলি কাটিয়ে অঙ্গের পূর্ণজন্মের মাধ্যমে আমরা আবার নিজেদেরকে তৈরি করে নিতে পারবো। যেমন, মনে করি আমার দেহের কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ, যেমন যকৃত এবং অগ্ন্যাশয় কোন কারনে বিকল হয়ে গেল বা আহত হলো। এখনকার সময়ে আমি মারা যেতে বাধ্য এধরনের সমস্যায়। কিন্তু একদিন হয়তো জিন থেরাপি বা এধরনের অন্য কোন চিকিৎসা উপায়ে ঐ মরণঘাতি সমস্যা থেকে বা একধরনের দৈহিক মৃত্যু থেকে ফিরে আসতে পারবো। ব্যাপারটা অনেকটা যন্ত্র মেরামতের মতো। ঘড়ির ব্যাটারি ঠিক আছে, কিন্তু কাঁটাগুলি ঘোরানো জিনিসপাতি নষ্ট। তখনও তো ঘড়ি চলবেনা। ফেলে রাখলে একসময় সেই ঘড়ির ব্যাটারিও শেষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ পুরোপুরি মৃত্যু। কিন্তু কলকব্জা ঠিক করে নিলে একই ব্যাটারি দিয়ে ঘড়িটি আবার সুন্দর চলতে থাকবে।

এতদূর যখন আশা করলামই তবে আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে সমস্যা কী? সেজন্য পরের পর্বে থাকছে ত্বকের কোষ থেকে কিভাবে ধাপে ধাপে একজন মানুষ ক্লোন করবেন তার পদ্ধতি।


পরবর্তী পর্বগুলি -

১। জীবনের সংজ্ঞা
২। আত্মাহীন রসায়ন
৩। বিশ্বভরা প্রাণ!
৪। আরএনএ পৃথিবীর আড়ালে
৫। শ্রোডিঙ্গারের প্রাণ!
৬। প্রথম স্বানুলিপিকারকের খোঁজে
৭। প্রাণের আধ্যাত্মিক সংজ্ঞার পরিসর দিন দিন ছোট হয়ে আসছে
৮। ত্বকের কোষ থেকে কিভাবে পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি করবেন
৯। গবেষণাগারে কিভাবে প্রাণ তৈরি করছেন বিজ্ঞানীরা
১০। সম্পূর্ণ সংশ্লেষিত জেনোম দিয়ে প্রথমবারের মতো ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি: এ কি কৃত্রিম ব্যাকটেরিয়া তৈরি হলো?


নির্ঘন্ট
নিধিকোষ = stemcell
ভ্রুণ নিধিকোষ = pluripotent stem cell
ভ্রূণায়িত নিধিকোষ = induced pluripotent stem cell
কেতুক = salamander
জলভল্লুক = tardigrade
বার্তাবাহক আরএনএ = messenger RNA


Comments

হিমু's picture

কাটা হাত-পা নতুন করে গজানোর এ বৈশিষ্ট্য কি শুধু এক্সোলোটলেরই, নাকি সব কেতুকেরই এটা আছে?

সজীব ওসমান's picture

সব কেতুক পারেনা বলেই জানি, কেউ কেউ পারে। এক্সোলটল তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত। আবার অন্য কিছু প্রাণী, যেমন তারামাছ আর সমুদ্র শসা, এরাও পূর্ণজন্মাতে পারে যেকোন অঙ্গ।

সোহেল ইমাম's picture

বাংলা বিজ্ঞানের প্রতিশব্দ গুলো খটমটে লাগে। প্রায় বিজ্ঞান নিয়ে রচনাগুলো খুব বেশিদূর পড়তে পারিনা। কিন্তু আপনি যখন লেখেন নিধিকোষ তখন লেখার শেষের নির্ঘন্ট না দেখেই বোঝা যায় এটা স্টেম সেল। আপনার লেখা এজন্যই ভালো লাগে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সজীব ওসমান's picture

অনেক ধন্যবাদ। হাসি

অতিথি লেখক's picture

প্রাণ একখান আচার। অবশ্য অনাচারও কওন যায়।সে যাই হোক, দারুণ লিখেছেন সজীব ওসমান।

---মোখলেস হোসেন

সজীব ওসমান's picture

হাসি আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

মন মাঝি's picture

ধর্মীয় মতে "প্রাণ" আর "আত্না" এক জিনিস না। প্রাণ আর "রুহ্‌"-ও এক জিনিস না। প্রাণ বা আপনি যে শরীরি কার্যক্রমের বর্ণনা দিয়েছেন, বিভিন্ন বিশ্বাস মতে তার সাথে আত্না বা রুহ-র কোনো সরাসরি, অবধারিত বা এক্সক্লুসিভ সম্পর্ক নেই। কোনো-কোনো ধর্ম কিম্বা বিশ্বাস মতে সব প্রাণীরই প্রাণ থাকলেও শুধু মানুষেরই আত্না বা রুহ আছে - অন্য প্রাণীর নাই, আবার কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস মতে মানুষসহ সব প্রাণীরই আত্না আছে, কোনো-কোনো বিশ্বাস মতে শুধু সব প্রাণীই না - উদ্ভিদেরও আত্না আছে, আবার কোনো-কোনো বিশ্বাস মতে শুধু সব প্রাণী ও উদ্ভিদই না - এমনকি প্রাণহীণ বস্তুরও আত্না আছে! দেখতেই পাচ্ছেন, এই আত্না-কন্টিনিয়ামে মানুষ ছাড়া আর কারও আত্না নাই থেকে শুরু করে নিষ্প্রাণ বস্তুরও আত্না আছে পর্যন্ত কিম্বা আরও বহু-বহু দূর পর্যন্ত আত্নার আবাসন-ব্যবস্থা বিস্তৃত। আবার এর মধ্যে প্রাণ ও আত্না পরস্পর-নির্ভরশীল থেকে শুরু করে পরস্পর-স্বাধীণ - সবই আছে। সুতরাং আত্নাবাদীদের অনেকে বলতেই পারে যে এইসব শরীরি কার্যক্রম বিশ্লেষন করে আত্নাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আত্না অধরা।

আত্নার আধ্যাত্নিক সংজ্ঞার পরিসর আসলে এভাবে কমবে না বা কমানো যাবে না। অধ্যাত্নবাদী চিন্তার মধ্যে একটি-দু'টি নয়, বরং এ সংক্রান্ত অসংখ্য বিভিন্নমুখী মতবাদ আর সংজ্ঞা রয়েছে - এবং এসব সংজ্ঞা আর মতবাদগুলি পাটি বা মাখানো ময়দার দলার (dough) মতই অসম্ভবরকম ম্যালিয়েবল, আবার বান মাছের মতই পিচ্ছিল। আপনি যতই যুক্তি আর বৈজ্ঞানিক প্রমানাদি দেন না কেন, এসব মতবাদ আর সংজ্ঞার কোনো-কোনোটা বা অনেকগুলিই হয়তো ঠিকই আপনার যুক্তিজাল বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ-ট্রমানের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে নিজেদের পরিসর ঠিকই ধরে রাখবে। কখনো-সখনো বাড়িয়েও নিতে পারে। জোরে চেপে ধরলে হয় মাখা ময়দার মতই শেপ পালটে ফেলবে নয়তো পিছলে বেরিয়ে গিয়ে অন্য কোনোদিক দিয়ে নিজের পরিসর সৃষ্টি করবে। অধ্যাত্নবাদ এটা পারবে কারন বিজ্ঞান ও অধ্যাত্নবাদের অধিষ্ঠান দুইটা ভিন্ন প্লেন বা জগতে। বিজ্ঞানের অধিষ্ঠান যুক্তি আর বস্তুমুখী-জগতে, অধ্যাত্নবাদের বসবাস ভয়, আবেগ, কল্পনা আর উইশফুল থিঙ্কিং-এর জগতে। মুশকিল হলো নিজের জগতে বিজ্ঞানের প্রমান দাখিল করার দায় আছে, সেটাও আবার কঠিন, ধরাবাঁধা ও অতিস্বচ্ছ কিছু নিয়মের অধীনে। কিন্তু অধ্যাত্নবাদের তেমন কোন দায় বা নিয়ম নাই। এখন এই অবস্থা বা এরেঞ্জমেন্ট যতই বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানবাদীদের অপছন্দ হোক না কেন, যত উচ্চকণ্ঠেই আপনি এর প্রতিবাদ করেন না কেন - শুধু বিজ্ঞান দিয়ে বেশিকিছু করতে পারবেন না মনে হয়। পারবেন না কারন অধ্যাত্নবাদের জগতে বিজ্ঞানের জগতের নিয়ম ঠিকমত বা আপনার ইচ্ছামত খাটবে না। পারবেন না কারন অধ্যাত্নবাদের যে জগতের বিবরণ একটু আগে দিয়েছি তা বিজ্ঞানবাদীদের যুক্তির ধাক্কায় হাওয়া হয়ে যাবে না। পারবেন না কারন বিজ্ঞানের যুক্তি আর বস্তুমুখী-জগতের মতো অধ্যাত্নবাদের ভয়, আবেগ, কল্পনা আর উইশফুল থিঙ্কিং-এর জগতটাও কিন্তু আসলে একটা কঠিন বাস্তবতা। এই বাস্তবতা আমাদের মনুষ্যত্বেরই প্রায় অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই আপাত বায়বীয় জগতের বাস্তবতার কাঠিন্য তাই ঠিকমতো উপলব্ধি ও রিকগনাইজ না করতে পারলে আমার মনে হয়না কোনোদিনই এর কোনরকম পরিসর কমানো যাবে। এটা এত সহজে পারা যায় না বলেই দুনিয়ার বহু বিজ্ঞানীই যুক্তি ও বিজ্ঞান সম্পর্কে বহুকিছু জেনেও এবং এই ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেও একইসাথে অধ্যাত্নবাদী হতে পারেন। এটা এত সহজে পারা যায় না বলেই যুক্তিবাদ, নাস্তিবাদ, ইত্যাদি কয়েক হাজার বছর ধরেই (এবং আধুনিক বিজ্ঞান নিদেনপক্ষে কয়েক শত বছর ধরে) পৃথিবীতে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও এই সময়ে অধ্যাত্নবাদের জয়জয়কার ঠেকানো যায়নি। আমি এ ব্যাপারে তাই বেশ আশাহীন। অধ্যাত্নবাদের পরিসর কমতে বা কমাতে হলে আমার মতে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ও অগ্রগতির পাশাপাশি আরও বেশকিছু অপরিহার্য ফ্যাক্টর - যা অধ্যাত্নবাদ ও তার জগত বলুন ইকোসিস্টেম বলুন তাকে পরিপুষ্টি, শক্তি ও বেঁচে থাকার রসদ ও অক্সিজেন যোগায় - তাকে অবধারিত ভাবে ঠিক করতে হবে। এগুলি হলো- সর্বজনীনভাবে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীণতা ও অস্বাচ্ছন্দ্য দূর করতে হবে - এবং সর্বোপরি তার আর্থিক নিরাপত্তাহীণতা ও অনিশ্চয়তা সম্পূর্ণ দূর করে উচ্চমানের বৈষয়িক সচ্ছলতা দিতে হবে! সার্বিকভাবে তার জীবনে
নিরাপত্তাহীণতাবোধ আর অনিশ্চয়তাবোধ ব্যাপকভাবে কমিয়ে উচ্চমাত্রার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-স্থিতি-নিশ্চিতি আনতে হবে। তবেই তারা ভয়ভীতি ইত্যাদিজনিত অধ্যাত্নবাদী-পলায়নবাদী কল্পনার জগতে আশ্রয় নেয়ার বদলে বস্তুমুখীজগতের প্রতি পুরোপুরি মনোযোগী হতে সাহস ও আশ্বাস পাবে। তার আগে পর্যন্ত, অর্থাৎ যতদিন তার জীবনে বিভিন্ন ধরণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-স্থিতি-নিশ্চিতি-নিরাপত্তার ঘাটতি থাকবে, ততদিন অধ্যাত্নবাদের জগতটাও সেই জীবনে সমানুপাতিক হারে তার পরিসর বৃদ্ধি করেই চলবে - এবং ভাইসে ভার্সা (এই ভাইসে ভার্সাটা গুরুত্বপূর্ণ)। এ সমস্তকিছুর উপরেই শেষমেশ নির্ভর করবে আত্নারামের থাকা বা না-থাকা! হাসি

****************************************

সোহেল ইমাম's picture

সুন্দর বলেছেন। তবে বিজ্ঞান চর্চার ধারাটাও থাকতে হবে। পদার্থ রসায়ন জীব বিজ্ঞানের পাশাপাশি নৃতত্ত্ব, ফোকলোর যে বিষয় গুলোও বিজ্ঞান সম্মত পথেই মানুষকে আর মানুষের আচরন, প্রথা, অনুষ্ঠানকে বিশ্লেষন করতে চায় সেগুলোরও দরকার আছে। এক একটা আধ্যাত্মিক বিশ্বাসকে রূপক বানিয়ে পরিবর্তনশীল যে কোন বিজ্ঞানের আবিস্কারের সাথে মিলিয়ে দেওয়া যায়। সে প্রয়াস আমরা বিজ্ঞানময় কিতাব প্রসঙ্গে বহুবারই দেখেছি। কিন্তু আদিম কোন ধারণা, বা কোন আদিম ছেলেমানুষী গোছের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানুষের দেবতা সম্পর্কিত বা আধ্যাত্মিক ধারণার বিবর্তনটা নৃতত্ত্ব, ফোকলোর কেন্দ্রিক আলোচনায় আরো স্বচ্ছ হয়ে ধরা পড়ে। ফোকলোর বা নৃতত্ত্ব বিষয়ক লেখা আরো বেশি আসা উচিত বলি মনে করি, অন্যান্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পাশাপাশিই। তবে আপনি যে বিষয় গুলো উল্লেখ করেছেন সেগুলো সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ

Quote:
নিরাপত্তাহীণতাবোধ আর অনিশ্চয়তাবোধ ব্যাপকভাবে কমিয়ে উচ্চমাত্রার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-স্থিতি-নিশ্চিতি আনতে হবে। তবেই তারা ভয়ভীতি ইত্যাদিজনিত অধ্যাত্নবাদী-পলায়নবাদী কল্পনার জগতে আশ্রয় নেয়ার বদলে বস্তুমুখীজগতের প্রতি পুরোপুরি মনোযোগী হতে সাহস ও আশ্বাস পাবে। তার আগে পর্যন্ত, অর্থাৎ যতদিন তার জীবনে বিভিন্ন ধরণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-স্থিতি-নিশ্চিতি-নিরাপত্তার ঘাটতি থাকবে, ততদিন অধ্যাত্নবাদের জগতটাও সেই জীবনে সমানুপাতিক হারে তার পরিসর বৃদ্ধি করেই চলবে

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

মন মাঝি's picture

Quote:
তবে বিজ্ঞান চর্চার ধারাটাও থাকতে হবে।

তাতো বটেই! সেকথা তো কয়েকবারই বলেছি মনে হয়। যখন বলেছি -

Quote:
শুধু বিজ্ঞান দিয়ে বেশিকিছু করতে পারবেন না মনে হয়

-- তখন এই "শুধু"-র কারনে বাক্যটার ইমপ্লিসিট মানে দাঁড়ায় - "বিজ্ঞান অবশ্যই লাগবে, তবে আরও কিছু মালমশল্লা লাগবে এই রেসিপিতে..." - এই জাতীয় কিছু। সেকথা আরও স্পষ্ট করেছি পরে এক জায়গায় --

Quote:
অধ্যাত্নবাদের পরিসর কমতে বা কমাতে হলে আমার মতে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ও অগ্রগতির পাশাপাশি...

-- "পাশাপাশি" বলার মানেই হচ্ছে "জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ও অগ্রগতি"-টা থাকতেই হবে! আরও লক্ষনীয়, আমি শুধু "বিজ্ঞানের" কথা বলি নাই। "জ্ঞানবিজ্ঞান" - মানে হচ্ছে বিজ্ঞান + সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, ফোকলোর, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, দর্শন, ইত্যাদি ইত্যাদি... হাসি

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

শুরুর বিশ্লেষনে সহমত। শেষের সমাধানে আংশিক একমত। যা চেয়েছেন সেটা করা প্রায় অসম্ভব। মানুষের মনের জটিল প্রকৃতির জন্য উচ্চমানের বৈষয়িক সচ্ছলতা, নিরাপত্তা, ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা, উচ্চমাত্রার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-স্থিতি-নিশ্চিতি এক একটা সোনার হরিণের মতো মুভিং টার্গেট।

মানুষের মনের প্রকৃতি, চিন্তার প্রকৃতি - এসব গভীরভাবে অধ্যয়ন ও অনুধাবনের প্রয়োজন আছে। নয়তো ঈশ্বরে বিশ্বাস, ধর্মে আস্থা, আত্মার অস্তিত্ত্বে প্রত্যয়, স্বর্গের আশা, নরকের ভয় - এগুলো শত-সহস্র বছর ধরে কীভাবে মানুষের মধ্যে টিকে আছে ও নানা ফর্মে বিকশিত হচ্ছে তা বোঝা যাবে না। কোন কিছুকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেবার আগে জিনিসটার ব্যবচ্ছেদ করে দেখা দরকার কোন সে উপাদান এটা ধারণ করে যা তাকে এতগুলো বছর ধরে এত বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে টিকিয়ে রেখেছে। এই নন্‌-রিলিজিয়াস স্পিরিচুয়ালিস্টদের যুগে বিষয়গুলো আরও জটিল, আরও কঠিন হয়েছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তারেক অণু's picture
অতিথি লেখক's picture

ইয়ে মানে বলছিলাম কি, প্রথম ছবিটা একটু এদিক ওদিক করে দেয়া যায় না? অফিসে মেয়ে কলিগের সামনে পেজটা খুলে শুরুতে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম।

নীড় সন্ধানী's picture

প্রাণ নিয়ে আপনার এমন আলোচনাগুলো পড়ে মনেই হয় না যে এখানে বিজ্ঞানের কঠিন কচকচানি আছে পরতে পরতে। জীবন নিয়ে রহস্যের সীমা নেই। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল সেই রহস্যের কিনারা দিয়ে হাঁটছে বিজ্ঞান - আরেকটু হলেই পৌঁছে যাবে। এক হাজার বছর পর হয়তো বাকী রহস্যও ঘুঁচে যাবে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.