বসনিয়ার ডায়েরি-০২

জীবনযুদ্ধ's picture
Submitted by jibonjudho [Guest] on Fri, 28/08/2015 - 8:21pm
Categories:

সারায়েভো শহরে আমাদের বাসটি যখন এসে পৌঁছুল তখন দিনের শেষ আলোটুকু মুছে গিয়ে সবেমাত্র রাজপথের টিমটিমে আলোগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। বাস থেকে নেমে একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সেই বাস স্ট্যান্ডের ঠিক ডান দিকে কয়েক কদম দূরেই ট্রেন ষ্টেশন, এখান থেকেই আমাকে হোটেলের লোকের এসে তুলে নেবার কথা। ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে সেই নির্দেশিত পথে পা বাড়াতে গিয়ে দেখি সেই কাঙ্ক্ষিত ভবনের সামনে বিশাল এক বাঁধানো চত্বর। ম্লান আলোয় দেখলাম কেবল দু’ চারজন যুবক সেই চত্বরে দাঁড়িয়ে হয়তো দিনের শেষ আড্ডাটুকু সেরে নিচ্ছে। চত্বরকে সামনে রেখে বিশাল কাঁচের শার্শিওয়ালা যে ভবনটি সেই কি তবে রেল ষ্টেশন? একটু দ্বিধা হলেও ভাবলাম ভেতরে গিয়ে দেখাই যাকনা।

আজকাল বহু ব্যাপারেই সেরা দশের লিস্টি বেরোয়। এই যেমন সেরা দশ সৈকত শহর, সেরা দশ ব্যয়বহুল শহর, সেরা দশ বিদ্বান লোকের শহর, এমনিভাবে কোনদিন যদি বেরোয় সেরা দশ ভূতুড়ে ট্রেন স্টেশনের লিস্টি তাহলে আমার মনে হয় এই সারায়েভো ট্রেন স্টেশনটির নাম সে লিস্টে থাকার উজ্জ্বল সম্ভাবনা। ভারী এক কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে ভেতরের যে পরিবেশ দেখলাম তাকে ভূতুড়ে ছাড়া আর কি বলি? ভেতরে ঢুকতেই চোখে পরে উঁচু ছাঁদের বিশাল এক হলঘর, হলঘরের মাঝে এখানে সেখানে কিছু বেতের চেয়ার রাখা। স্টেশনের ভেতরকার দোকানগুলোর দোকানিরা ঝাঁপ ফেলে বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই। আমি ছাড়া তখন সেখানে আর দু’জন মাত্র মানুষ, তারা এই স্টেশনেরই কর্মচারী। হলঘর থেকে কিন্তু প্ল্যাটফর্মের রেললাইন দৃশ্যমান হয়না, কারণ সেগুলো এই হলঘরের পেছনের দিকে বন্ধ দরজার ওপাশে। ওদিকে বহু উঁচুতে হলঘরের ছাঁদে আঁকা স্থানীয় ভাষায় নানা পদের গ্রাফিটি। হোটেল থেকে আমাকে নিতে আসতে আরও প্রায় ঘণ্টা খানেক দেরি, তাই ভাবলাম হোটেলে একটা ফোন করে জানিয়ে দিলেই তো হয়। সেই কর্মচারী দুজনকে আকারে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম তাদের কাছে কোনও মুঠোফোন আছে কিনা। তারা উল্টে আমাকে হাত নেড়ে সেই ষ্টেশনের এক ধারে অযত্নে পরে থাকা কয়েকটি পাবলিক ফোনের দিকে নির্দেশ করলো। পকেটে যেহেতু কিছু বসনিয়ান পয়সা ছিল, তাই ভাবলাম বাহ সমস্যার সমধান এই বুঝি হল। কিন্তু সেই ফোনগুলোর কাছে গিয়ে টিপেটুপে যা বুঝলাম এই ফোন পয়সায় কাজ করেনা, এখানে এক ধরণের বসনিয়ান ফোন-কার্ড ব্যাবহার করতে হয়। আচ্ছা জ্বালায় পরা গেলো, এখন আমি সেই কার্ড পাই কোথায়? ওদিকে কার্ড বিক্রির দোকানগুলোর একটিও তখন খোলা নেই। ওদিকে মনে মনে ভাবছি, চিঠিতে তো হোটেলকে বলেছি লোক পাঠাতে, কিন্তু যদি তারা ভুলে যায়? তাহলে এই জনমানবশূন্য স্টেশনে আমি ট্যাক্সিই বা পাব কি ভাবে? সেই কর্মচারী দুজন এতক্ষণ আসলে অপেক্ষা করছিলো সেদিনের শেষ ট্রেনটির জন্যে, যেটি এসে পৌছুলো রাত দশটা নাগাদ। অনেকটা এ সময়েই সেই ষ্টেশন সংলগ্ন চত্বরে একটি গাড়ি এসে থামল। বেশ খুশি হয়ে উঠলাম আমি। ভাবলাম এই বুঝি আমার অপেক্ষার পালা শেষ, এ নিশ্চয়ই হোটেল থেকে এসেছে আমাকে নিয়ে যেতে। গাড়ি থেকে যিনি নামলেন তার কাছে গিয়ে ইংরেজিতে তাকে জিজ্ঞেস করাতে বুঝলাম বেচারা এক বর্ণ ইংরেজিও বোঝেনা। হাত নেড়ে কিছুটা হতাশ ভঙ্গিতে নিজের অপারগতা জানিয়ে হনহনিয়ে সে ঢুকে গেলো স্টেশনের ভেতরের দিকে। একটু পরে একটি কিশোরকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখে বুঝলাম সে আসলে এসেছে এই শেষ ট্রেনের যাত্রী এই কিশোরটিকে ষ্টেশন থেকে তুলে নিতে। আমি যে তার কাছে কোনও প্রয়োজনে সাহায্য চাইছিলাম, ব্যাপারটা কিন্তু সে আঁচ করতে পেরেছিল। আমাকে দূর থেকে দেখে সেই কিশোরটিকে বগলদাবা করে সে এবার ছুটে এলো আমার দিকে। বুঝলাম সে বসনিয়ান ভাষায় কিশোরটিকে বলছে আমাকে জিজ্ঞেস করতে যে কি সাহায্য করতে পারে তারা। হ্যাঁ সেই কিশোরটি ভালোই ইংরেজি বোঝে এবং বলতে পারে। অবশেষে তার কাছে খুলে বললাম সব বৃত্তান্ত। সব শুনে কিশোরটি বলল এই কথা? দাও তোমার হোটেলের নম্বরটা, আমার মুঠোফোন থেকে এখুনি ওদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি। এই কিশোরটি হয়তো জানেনা সেদিন সে আমাকে কিভাবে বাঁচিয়ে দিল। কারণ ওরা চলে যাবার ঠিক মিনিট দুয়েক বাদেই সেই কর্মচারী দুজন এসে আমাকে জানাল আমাকে গিয়ে দাঁড়াতে হবে বাইরের চত্বরে। যেহেতু শেষ ট্রেনটিও চলে এসেছে, তাই তারা এখন মূল দরজা বন্ধ করে বাড়ির দিকে হাঁটা দেবে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরা সেই চত্বরে পূবের ইগমান পর্বত থেকে ধেয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মিনিট দশেক পরে দেখলাম টিমটিমে দুটো হেডলাইট আমার দিকেই যেন আসছে। জানিনা সেই কিশোরের ফোন থেকে সময়মত না জানালে এভাবে আরও কতকাল এই হিমশীতল বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।

পুরনো মডেলের এক ঢাউস মারসিডিস গাড়ির দরজা খুলে যিনি নামলেন তাকে ঠিক কর্মচারী বলে মনে হয়না, আসলে তিনি তা ননও। গাড়ি চলা শুরুর পর কুশল বিনিময়ের পরই জানলাম তিনি অর্থাৎ মুগদিবই আসলে এই হোটেলের মালিক। এই হোটেল ছাড়াও মুগদিব অধুনা এক রেস্তোরাঁ খুলেছে, তাকে মূলত সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয় সেই রেস্তোরাঁ নিয়েই। আর বলতে গেলে হোটেলটি চালায় তার বিধবা মা আর তার তুর্কী বউ। যুদ্ধের প্রথম বছরটা কোনও রকমে পালিয়ে বেঁচে মুগদিবদের পরিবারটি প্রথমে যায় জার্মানি, তারপর সেখান থেকে নেদারল্যান্ড। সেখানেই মুগদিবের সাথে পরিচয় হয় তার বর্তমান অর্ধাঙ্গিনীর। নেদারল্যান্ডে বছর ছয়েক কাটাবার পর এই পরিবারটি সিদ্ধান্ত নেয় এবার তারা ফিরে যাবে তাদের প্রিয় বলকানে। জমানো টাকা নিয়ে ফিরে মুগদিব প্রথমেই দাড় করায় এই হোটেল, আর তারপর এই রেস্তোরাঁটি।

অনেক কথার ফাঁকে মুগদিব বলল, ”যাবার পথে যদি আমার রেস্তোরাঁতে একটু থেমে যাই তুমি কি কিছু মনে করবে? আমার এক কর্মচারী থাকে পাশের শহরে, আজ কাজে দেরি হওয়ায় বেচারা বাড়ি ফেরার শেষ বাসটা ধরতে পারেনি। তাই ওকে আজ রাতটা আমার হোটেলে নিয়ে রাখব”।

“আরে না না আপত্তি কি, আর তা ছাড়া আমারও বেশ খিদে পেয়েছে, তোমার রেস্তোরাঁতে গেলে তো ভালোই হয়, সেখান থেকেই কিছু মিছু খেয়ে নেয়া যাবে বরং।“

মুগদিবের রেস্তোরাঁটি পেশ পরিপাটি, ছিমছাম। রেস্তোরাঁয় ঢুকেই মুগদিব তার কর্মচারীদের হুংকার ছাড়ল, “আজ আমি একজন বাংলাদেশী অতিথি নিয়ে এসেছি, কি কি খাবার আছে বল”। একজন কর্মচারী বেশ কাঁচুমাচু মুখে বলল, “ইয়ে মানে কিছুই তেমন আর অবশিষ্ট নেই, আজকের মতো প্রায় সবই বিক্রি বাটা হয়ে গেছে, ওদিকে আমরা চুলোটুলো ও সব বন্ধ করে সব কিছু ধুয়ে মুছে ফেলেছি”। কিই বা আর করা, বিধি বাম।

সে রাতের অন্ধকারে ঠিক ভালো মতো ঠাহর করতে না পারলেও পরদিন সকালের আলোয় বুঝেছি মুগদিবদের এই হোটেলটি আসলে মূল সড়ক থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে এক পাড়ার ভেতর অবস্থিত। চারপাশটা এখনও বেশ সুনসান। হোটেলের ঠিক পেছনেই এক রুক্ষ আগাছায় ভরা মাঠ, আর তার পেছনেই শুরু হয়েছে পাইন গাছে ছাওয়া পাহাড়ের সারি। মুগদিবের কাছ থেকে ঘরের চাবি আর হোটেল থেকে শহরের কেন্দ্রে যাবার বিস্তারিত দিক নির্দেশনা নিয়ে ঘরে ঢুকে সবে মুখ হাত ধুচ্ছি, এমন সময় দরজায় কার যেন টোকা। এমন সময় তো কারও আসবার কথা নয়! দরজা খুলে দেখি বেশ লজ্জিত মুখে হাতে একটি থালা নিয়ে মুগদিব দাঁড়িয়ে। যেন এক মহা অপরাধ করে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে সে বলল, “তোমাকে তো আমার রেস্তোরাঁয় নিয়ে কিছুই খাওয়াতে পারলাম না, তুমি নিশ্চয়ই খুব ক্ষুধার্ত। এতো রাতে তো আর কোথাও যেতেও পারবে না। রান্না ঘরের ফ্রিজে এই কিছু পাউরুটি আর জেলি পেলাম, এগুলো দিয়েই বরং আজ রাতের ক্ষুধাটা মিটিয়ে নাও।“ ধন্যবাদ জানিয়ে ওর হাত থেকে থালাটা নেবার সময় বললাম, “মুগদিব তুমি নিশ্চয়ই একজন চমৎকার মানুষ।“

পরদিন সকালে হোটেলের লবিতে পৌঁছে দেখি দুহাতে দু’ পুতুল নিয়ে মুগদিবের চার বছর বয়সী ছোট মেয়েটি ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। আর তার পেছনে ছুটছে তার দিদা, মুগদিবের মা। আমাকে দেখে এক গাল হাসি দিয়ে বৃদ্ধা অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন প্রাতরাশের টেবিলের দিকে। আয়েশ করে বসে এক গ্লাস কমলার সরবত গলাধঃকরণ করার পর সবে খোলস ছাড়িয়ে সেদ্ধ ডিমটি মুখে পুরতে যাব এমন সময় হেলতে দুলতে ঢুকে যিনি লবির কাউন্টারে এসে বসলেন তিনিই মুগদিবের সেই তুর্কী বউ। এই বউটি অবশ্য খুব বেশিক্ষণ হোটেলের কাউন্টার সামলায়না। এমনকি গত রাতে যখন হোটেলে এসে পৌঁছেছিলাম তখনও এই লবিতে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন ওই মুগদিবের বুড়ি মাই। অর্থাৎ ভোর থেকে রাত অবধি বেচারি এই কাউন্টার তো সামলানই, পরে জানতে পেরেছিলাম হোটেলের সকল সাফসুতরোও তাকেই নিজ হাতে করতে হয়। ছেলের বউটি শাশুড়িকে এসব কাজে খুব একটা সাহায্য করে বলে মনে হলনা।

এ পাড়ায় এই হোটেল বাড়িটি ছাড়া আর সবই মোটামুটি বসতবাড়ি। তার কোনটির উঠোনে হয়তো ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে লালচে আপেলের ঋজু গাছ আবার কোনটির উঠোন হয়তো ঢাকা পরে গেছে ম্যালবেরির চাঁদরে। এসব পেড়িয়ে পাড়ার মাথায় পৌছতেই দেখা পেয়ে গেলাম ঠং ঠং শব্দে থেমে যাওয়া হলদে রঙের সেই ষাটের দশকের এক ট্রামের। ইউরোপের আর কোনও শহরে এতো পুরনো ট্রাম চলে কিনা সন্দেহ। অথচ ইউরোপে কিন্তু ট্রামের যাত্রা শুরু হয়েছিলো এই শহরটি থেকেই। সকালের প্রথম ভাগ বলেই হয়তো ট্রামের ভেতর ভিড়টা তখনও তেমন নয়। যাত্রীদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ শ্রেণীর, পরনে যাদের উজ্জ্বলতা হারানো বহুকালের পুরনো জীর্ণ কিছু কোট। সারায়েভো শহরটিতে পরেও ঘুরে আমার মনে হয়েছে এ শহরে যেন আনুপাতিকভাবে তরুণদের চেয়ে বুড়োদের উপস্থিতিই একটু বেশি, হয়তোবা কাজের সন্ধানে তরুণদের দেশান্তরী হওয়াটা এর পেছনের কারণ।

সারায়েভো শহরের কেন্দ্রস্থলটি হল শহরের পশ্চিম প্রান্তে আর আমার হোটেলটি ছিল শহরের একেবারে পূর্ব প্রান্তে। এতে বরং একদিকে ভালোই হল। ট্রামে যেতে যেতে পুরো শহরটিই একবার দর্শন হয়ে গেলো। এর মাঝে এমন অনেক ভবন বা এলাকা নজরে এলো যেগুলোর ছবি নব্বই এর দশকে টিভিতে দেখেছি বহুবার। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম কাল এই রাস্তাটুকু পদব্রজেই ঘুরতে হবে, তাতে হয়তো একটু সময় লাগবে। তা লাগুক, কিন্তু তারপরও এই জায়গাগুলো আমি চলন্ত ট্রাম থেকে না দেখে খুব কাছ থেকে দেখতে চাই।

শীর্ণকায় মিল্যাস্কা নদীর ওপর পাঁচশ বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাটিন সেতুর যে প্রান্তে ট্রাম আমাকে নামিয়ে দিল সেখানে কয়েক মুহূর্ত আমাকে থমকে দাঁড়াতেই হল। কারণ এই ল্যাটিন সেতুর ঠিক দোরগোড়ার এই জায়গাটিতেই খুন হয়েছিলেন অস্ট্রো–হাঙ্গেরিয়ান সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ ফারদিনান্দ। যার জের ধরে বেজে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা, যে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ পরবর্তী চার বছরে ছড়িয়ে যায় ইউরোপের নানা কোণায়। ল্যাটিন সেতু নামটি যেহেতু বললামই, তাই এ ফাঁকে আর এক ছোট্ট ঘটনার কথা বলে রাখি। সকালে হোটেল থেকে বেরুবার সময় মুগদিবের মাকে নিজ্ঞেস করেছিলাম ল্যাটিন সেতুতে যাব, তা কোন দিকে যেতে হবে বৃদ্ধা জানেন কিনা। আমার কথা শুনে বৃদ্ধা বেশ চিন্তিত ভাবে ঈষৎ দ্বিধাগ্রস্থ স্বরে বললেন এটি মনে হয় শহরের পূর্ব দিকে হবে। মাথা চুলকে ভাবছিলাম এমন একটি বিখ্যাত সেতুর সঠিক অবস্থানের কথা এই বৃদ্ধা জানেন না, এ কেমন কথা? নাকি মাঝে বেশ কিছুকাল প্রবাসে থেকে বৃদ্ধা এই শহরের অনেক জায়গার নামই ভুলে গেছেন? পরে বুঝেছিলাম আর জেনেছিলাম আসলে ব্যাপারটা কি। পুরো যুগোস্লাভ সময়ে আসলে এই সেতুটির নাম ছিল প্রিনসিপ সেতু। যার নামে ছিল এই সেতুর নাম সেই যুগোস্লাভ জাতীয়তাবাদী প্রিনসিপের হাতেই খুন হয়েছিলেন ফারদিনান্দ। বসনিয়া যুদ্ধের পর এই সেতুর নাম বদলে প্রিনসিপ সেতুর জায়গায় রাখা হয় ল্যাটিন সেতু। সেটা কি প্রিনসিপ জাতিতে সার্ব ছিলেন বলে? হতে পারে। প্রিনসিপ কিন্তু সার্ব জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন না দেখে দেখতেন অখণ্ড যুগোস্লাভের স্বপ্ন, যে স্বপ্ন হয়তো আজকের বাস্তবতায় অর্থহীন। নাম বদলের এমন ঘটনা শুধু এই সেতুর ক্ষেত্রে নয়, বলকানের আরও বহু জায়গাতেই আমার চোখে পড়েছে। যুগোস্লাভ বা সমাজতান্ত্রিক সময়ের অনেক নেতা, ফৌজি কিংবা বিপ্লবীদের নামে রাখা সড়ক, ষ্টেশন বা সেতুর নামই আজ বদলে ফেলা হয়েছে অতীতের অনেক স্মৃতি মুছে ফেলার জন্যে। কিন্তু পুরনো আমলের অনেকেই এখনও সেইসব স্থাপনাকে চেনেন সেই আগের নামেই, নগর কর্তৃপক্ষের বদলে ফেলা নাম ফলকগুলো কেবল নতুন প্রজন্মের মানুষদের সেই নতুন নামগুলোর সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করে।

হলুদ দুর্গ মোটেও হলদে নয়, কিংবা কে জানে হয়তোবা ছিল কোনও এক কালে। কয়েকশ বছর ধরে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে হয়তো সেই হলদে রংই আজ হয়েছে ধুসর তামাটে বর্ণের। তা সে যে বর্ণেরই হোক না কেন সারায়েভোর পূর্বতম প্রান্ত থেকে অক্ষি কোটরর মধ্য দিয়ে যদি গোটা শহরটাকে এক দৃষ্টিতে দেখে নিতে চান তবে আপনাকে আসতেই হবে ইয়াকভাচ পাহাড়ের উপর দাঁড়ান এই দুর্গে। আসলে শুধু শহরই নয়, এই দুর্গের খোলা চত্বরে না দাঁড়ালে কোনদিনও হয়তো বুঝতেই পারতামনা সারায়েভো যুদ্ধে কেন প্রথম থেকেই সার্বরা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। বলি তবে সেই কারণটি। সারায়েভো মূলত এক উপত্যকা শহর, এর চারপাশে ঘিরে রয়েছে পাইন, লিন্ডেন আর বার্চ বনে ছাওয়া পর্বতমালা। সার্বরা যখন বুঝে যায় রাজনৈতিক আলোচনায় না গিয়ে তারা আসলে বল প্রয়োগের পথ বেছে নেবে তখনি তারা নীচের সমতলে এলাকা-ভিত্তিক যুদ্ধে না গিয়ে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয় এই পর্বতগুলোর গায়ে। হলুদ দুর্গের ঠিক বাঁ পাশের ত্রেবেভিচ পর্বতে আজও দৃশ্যমান ঠিক যে বরাবর পাইনের বন ছেঁটে মর্টারের চাকা বসান হয়েছিলো। শুধু এই বাঁ পাশের পাহাড়ই নয়, এই শহরকে ঘিরে থাকা সব কটি পর্বতের ঢালগুলোতেই তারা শক্ত অবস্থান নিয়ে নেয় যুদ্ধের একেবারে শুরুতেই। কৌশলগত এই সুবিধাজনক অবস্থানের কারণেই তাদের স্নাইপার দলের পক্ষে মানুষ শিকার অনেক সহজ হয়ে পরে।

এই হলুদ দুর্গের সুউচ্চ প্রাকারটি যেখানে গিয়ে মাটির সাথে মিশেছে সে জায়গাটি সবুজ ঘাসের গালিচা ঘেরা মাঠের মতো, এককালে নাকি এটি ছিল আশেপাশের পাড়ার শিশুদের খেলার মাঠ। আজ অবশ্য সেই মাঠ উধাও, বরং সেই মাঠের জায়গা দখল করেছে ঘন সন্নিবেশে পোঁতা অসংখ্য শ্বেত মর্মর পাথরের স্তম্ভ। বহু দূর থেকে দেখলে মনে হয় এ যেন এক শ্বেত স্তম্ভের অরণ্য। প্রায় চার বছর ব্যাপী অবরুদ্ধকালে শহরবাসীদের এই পার্ককেই কবরস্থান বানান ছাড়া আর কোনও উপায় ছিলনা। এই সমাধিস্থলে আমি যখন প্রথম পা রাখি যে প্রশ্নটি আমার মাথায় প্রথম আসে সেটি হল সেই সময়ে পুরো সারায়েভো শহরের কি এতই স্থানাভাব ছিল যে এই ভূতপূর্ব পার্কটিকে কবরস্থানে পরিণত করতে হবে? সারায়েভো তো কোনও ঘনবসতিপূর্ণ শহর নয়, আমার হোটেলটি যে এলাকায় সে এলাকায় তো দেখে এলাম এখনও কত পতিত জমি পরে রয়েছে প্রধান রাস্তার পাশেই। এর পরে সারায়েভো শহরটিতে আরও চক্কর মারার পর এবং স্নাইপারদের বিশদ অবস্থাগুলো জানার পর আমার এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম। এই কবরস্থানটি শহরের পশ্চিম প্রান্তে অর্থাৎ যেখানে যুদ্ধের তীব্রতা আনুপাতিক ভাবে বেশি ছিল, আর তখনকার সময়ে প্রায় পুরো সারায়েভো শহরটাই ছিল সার্ব স্নাইপারের রাইফেলের লক্ষ্যভেধি কাঁচের তলায়। তাই খুব সম্ভবত এখানে অর্থাৎ এই এলাকায় যত মানুষ মারা গেছে তাদের সবাইকে গাদাগাদি করে এই পার্কের মাটি খুড়েই কবর দেয়া হয়েছে। শুধুশুধু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তখন কারও পক্ষেই সম্ভব ছিলনা শহরের অন্য কোনও প্রান্তে গিয়ে অন্য কোনও ফাঁকা পুরনো গোরস্থানে মৃতদের দেহ সমাহিত করা। এই গোরস্থানের খুব কাছেই আরেকটি গোরস্থান, তবে সেটি আরও বিশাল। শুনলাম সেটিও নাকি যুদ্ধের আগে ছিল এলাকার যুবকদের ফুটবল খেলার মাঠ। আশেপাশের খালি জায়গাগুলো যখন ভরে উঠলো তখন আস্তে আস্তে এই ফুটবল মাঠের দক্ষিণ প্রান্ত থেকেও গোর খনন শুরু হল।

গত শতাব্দীতে স্তালিনগ্রাদের পর যে শহরটি সব চেয়ে বেশি সময় শত্রুর দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে ছিল সে শহরটি হল সারায়েভো। একটি দুটি নয়, পুরো প্রায় চারটি বছর এই শহরের অবরুদ্ধ দশা কাটে। বিদ্যুৎ নেই, পানিয় জলের লাইন বন্ধ- সে এক অবিশ্বাস্য অরাজক ভীতিকর এক পরিস্থিতি। সেদিন সারায়েভোর অলিতে গলিতে হাঁটতে হাঁটতে টের পেলাম মোটামুটি শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছি। জুন মাসের শেষ সপ্তাহের সে দিনটিতে মেঘলা আকাশ যেন বয়ে নিয়ে এসেছে চার ধারের পর্বতের শীতল বাতাস। জুন মাসেই যদি এহেন ঠাণ্ডা অনুভূত হয়, তবে ঘোর শীতকালে এ অঞ্চলে যে কেমন ঠাণ্ডা পরে সেটা সহজেই অনুমেয়। তাই ভাবছিলাম, অবরুদ্ধ এই শহরের অধিবাসীরা কি করে সেই দুর্লঙ্ঘ শীতকালগুলো পাড়ি দিয়েছিল। সে কথা একজনকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলেছিল, “ আমাদের এখানে অধিকাংশ বাড়িতেই তুমি পুরনো কোনও বই পাবেনা, পাবেনা পারিবারিক ছবির পুরনো কোনও অ্যালবাম। বাড়ির চারপাশে ঝোপঝাড়ের কাঠ, ঘরের মেঝের কাঠ, চেয়ারের পায়া –এ সবই যখন নিঃশেষ হয়ে যেত তখন আমরা শেষ সহায় হিসেবে ছুঁড়ে দিতাম আমাদের ঘরের প্রিয় যত বই। যাতে আগুনের শিখা আরও কিছুক্ষণ প্রজ্বলিত থাকে। এ ছাড়া আমাদের আর কিই বা করার ছিল, আগে তো আমাদের বাঁচতে হবে তাই না?”। ওদিকে পানিয় জলের জন্যে পরিবারের সক্ষম পুরুষরা রাতের আঁধারে ছুটতেন শহরের একেবারে পশ্চিম কোণে, সেখানকার অল্প কিছু প্রসবনের জলই ছিল তাদের পানিয় জলের অন্যতম প্রধান অবলম্বন।

কিন্তু শুধু পানিয় জলের অভাব আর হাড় কাঁপানো শীত শুধু এগুলোই তো আর জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পথে একমাত্র বাঁধা না। অবরুদ্ধ শহরবাসীর সে মুহূর্তে বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজন ছিল খাদ্য আর প্রতি-যুদ্ধ করার অস্ত্র। আর এগুলো জোগাড় করার একমাত্র স্থান ছিল পূবের ইগমান পর্বতের অপর পাড়ের বসনিয়ান মুসলিম নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল। কিন্তু এই জোগাড়ের পথটা সরল ছিলনা মোটেও। কেন ছিলনা, সেটা বলতে গেলে সেই অবরুদ্ধ শহরের মানচিত্র সম্পর্কে একটু কথা বলতে হয়। সহজ করে বোঝার জন্যে কল্পনা করা যাক সেই মানচিত্রটি একটি আনুভূমিক ভাবে স্থাপিত ফানেলের আকৃতির মতো। ফানেলের ছড়ানো গোলাকার অংশটি পশ্চিম দিকে, যে দিকে সারায়েভোর কেন্দ্রস্থল। আর ফানেলের নিচের সরু অংশটি হল পূর্বমুখী সেই অঞ্চল যেটি ইগমান পর্বতের ওপারে বসনিয়ান মুসলিম নিয়ন্ত্রিত। ফানেলের উপরের ছড়ানো অংশের ভেতরের ভাগে সারায়েভো শহর, যে স্থানে কেবল তখন বসনিয়ান মুসলিমরা। আর এই ছড়ানো অংশের চারধারে উচ্চ পরবতগুলোয় রয়েছে সশস্ত্র সার্বরা। সমস্যা অনেক খানিই লাঘব হয়ে যেত যদি এই ছড়ানো অংশের ভেতরকার মুসলিমরা ফানেলের অন্য পাশের বহির্গমন পথের সরু অংশে অবাধে চলে যেতে বা যাতায়াত করতে পারতো। কিন্তু গোদের উপর বিষ ফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায় এই দু’ অংশের সংযোগস্থলে অবস্থিত সারায়েভো বিমানবন্দরটি। কারণ বিমানবন্দরটিতে ততদিনে ঘাঁটি গেড়েছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী, এবং “নিরপেক্ষতা” র স্বার্থে তারা বসনিয়ানদের কোনও ক্রমেই ওপারে যেতে দিতে নারাজ। তাদের যুক্তি ছিল এতে করে সার্বরা চটে গিয়ে যুদ্ধের পরিস্থিতি আরও সঙ্গিন দিকে মোড় নিতে পারে। এমতাবস্থায় বসনিয়ান সামরিক নেতারা স্থির করলেন তারা এই বিমানবন্দরের নিচ দিয়ে এক সুড়ঙ্গ খুঁড়বেন, যেটি সোজা চলে যাবে বিমানবন্দরের রানওয়ের নিচ দিয়ে। প্রায় চার মাস চার দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে তারা তৈরি করে ফেললেন সেই সুড়ঙ্গ। যদিও সুরঙ্গটি আজও অটুট কিন্তু দর্শনার্থী আর রানওয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে এই কেবল ১০ মিটারের মতো ভেতরে যাবার সুযোগ দেয়া হয়। এমন একটি বিখ্যাত সুরঙ্গের সেই ১০ মিটার যদি দেখার সৌভাগ্য হয় তাই বা কম কি? আমার পরবর্তী গন্তব্য তাই সারায়েভো বিমানবন্দর সংলঙ্গ সেই সুড়ঙ্গ।

চেরি আর ব্লুবেরি গাছে ছাওয়া যে দ্বিতল বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালাম তার সাথে এ পাড়ার অন্য বাড়িগুলোর তফাত সামান্যই। এ পাড়ার আর সব বাড়ির মতো এ বাড়িটির গায়েও ভারী গুলির অসংখ্য ছাপ। গুলির সেই দাগগুলো আজও বুজে দেয়া হয়নি। বাড়ির পাথুরে উঠোনে পা রাখতেই চোখে পরে লাল রঙের আলপনার মতো কিছু একটা। না আলপনা নয়, লাল রঙ্গে এই উঠোনের কিছু ক্ষতস্থানকে প্রলেপ দেয়া হয়েছে জানানোর জন্যে যে ঠিক এই স্থানেই বোমার শেলের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে কিছু মানুষ। এই বিশেষ বাড়িটি থেকে শুরু হয়েছে বিমানবন্দরের অপর পারে যাবার সেই সুড়ঙ্গ। এই বাড়িটির ভেতরে এখন বানানো হয়েছে ছোটখাটো এক জাদুঘর। সেখানে প্রদর্শিত হয় যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত কিছু বন্দুক, অবরুদ্ধ শহরবাসীর ঘরে বানানো মোম, কাঠ-কয়লার চুলো, এই সুড়ঙ্গ খোঁড়বার মামুলি সরঞ্জাম, সাহায্য হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পাওয়া তেল বা খাবারের টিন, ইত্যাদি। এই খাবারের টিনের কথা লিখতে গিয়ে আরেকটি কথা মনে পড়লো। সারায়েভোর এক স্থানে হটাৎ এক কৌটো সুলভ মনুমেন্ট দেখে চমকে গিয়েছিলেম। তার গায়ে লেখা, “কৌটোজাত গোমাংস, ওজন ৩৪০ গ্রাম”। প্রথমে এক ঝলক দেখে ভেবেছিলাম এটি নিশ্চয়ই কোনও বিজ্ঞাপনের উদ্দেশে নির্মিত। পরে এক বসনিয়ানের কাছ থেকে শুনেছিলাম এর পেছনের গুঢ় কাহিনী। সেই জাদুঘরের টিনের কৌটো আর আর মনুমেন্টের কৌটো এই দুয়ের মাঝ দিয়েই সারায়েভো আসলে পরবর্তী প্রজন্ম এবং বাইরের পৃথিবীকে জানাতে চায় ঠিক কি ধরণের খাদ্য-সাহায্য তারা পেয়েছিল সেই অবরুদ্ধ থাকাকালীন। শুনতে পেলাম, জাতিসঙ্ঘ তাদের যে বিস্কুটের টিনগুলো সরবরাহ করেছিল তার অনেকগুলোর গায়ে তৈরির সন লেখা ছিল, ১৯৬৩। আর ওই কৌটোজাত গোমাংসের কথা যা বললাম, তার অনেকগুলো ছিল সেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার। সারায়েভোবাসী তাদের কুকুরকে সেই মাংস খেতে দিলে এমনকি তারাও সেই মাংস খেতে অস্বীকৃতি জানাত। জাতিসঙ্ঘ বা বিশ্ব খাদ্য সংস্থা লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করে এভাবেই তাদের ভাড়ার খালি করেছে, যা ছিল এই শহরবাসীর প্রতি নির্মম এক প্রহসন। তাই সেই মনুমেন্ট গড়ে সারায়েভোবাসী যেন বলতে চেয়েছে, “ধন্যবাদ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আমাদের বিপদের দিনে এমন সব সুখাদ্য আমাদের পাঠাবার জন্যে”।

এবার সেই সুড়ঙ্গে নামবার পালা। সুরঙ্গটি এতই সঙ্কীর্ণ যে দুজনের পাশাপাশি চলার উপক্রম নেই আর চলতেও হয় মাথা নিচু করে। তার উপর এখন যেমন খটখটে শুকনো অবস্থায় এটিকে দেখছি, সব সময় নাকি অবশ্য সেরকম ছিলনা। উপরে বৃষ্টি বা তুষারগলা জল থাকলে এই সুরঙ্গতেও থক থক করতো কাদা জল। আর সেই মাড়িয়ে কাঁধে ৩০-৪০ কেজি ওজনের মাল নিয়ে সবাইকে এই সুড়ঙ্গ অতিক্রম করতে লেগে যেত কয়েক ঘণ্টা। যেহেতু এই সুড়ঙ্গ পথ খুবই সঙ্কীর্ণ, তাই উভয়মুখী জন চলাচলের উপায় ছিলনা। কয়েক ঘণ্টা সারায়েভো থেকে ইগ্মান পর্বত আর তার পরের কয়েক ঘণ্টা ইগ্মান থেকে সারায়েভো এভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা হতো মানুষের চলাচল। আচ্ছা সার্ব বাহিনী কি জানতোনা এই সুরঙ্গের কথা? এ কথা আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম জাদুঘরের একজনকে। জানতে পেলাম, সার্বরা জানতো ঠিকই। কিন্তু তাদের খুব বেশি কিছু করার ছিলনা, কারণ এ সুড়ঙ্গ ধ্বংস করতে গেলে তাদেরকে ধ্বংস করতে হতো বিমানবন্দরের রানওয়েকে। কিন্তু জাতিসংঘের বাহিনী সেখানে অবস্থান করায় বিমানবন্দর ধ্বংস করা স্বভাবতই তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা।

এই সুরঙ্গের কথা যখন শুরু করেছিলাম তখন বলেছিলাম অস্ত্র পরিবহনের কথাও। এই ব্যাপারটি নিয়েও বসনিয়ানদের ব্যাপক ক্ষোভ লক্ষ্য করেছি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি। তাদের মতে যুদ্ধের একটা বড় সময় জুড়ে বসনিয়ানদের প্রতি অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ছিল আসলে উন্নত দেশগুলোর কালো বাজারে চড়া দামে অস্ত্র বিক্রির পথ উন্মুক্ত করার জন্যে। কারণ ওই নিষেধাজ্ঞার ফলে অস্ত্র যে বসনিয়ায় আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো তা নয়, অস্ত্র বিভিন্ন পথে আসতো ঠিকই। শুরুতে অস্ত্র খালাশ করা হতো ক্রোয়েশিয়ার দুব্রভনিক বা স্প্লিট বন্দরে। সেখান থেকে হার্জেগোভিনার মধ্য দিয়ে অস্ত্র আনা হতো বসনিয়ায়। কিন্তু যুদ্ধের অব্যাবহিত পরে ক্রোয়েশিয়ার সাথেও সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পরলে অস্ত্র আনা শুরু হয় দক্ষিণের দুর্গম পাহাড় আর বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে। এই অস্ত্রর চালানগুলো বসনিয়ান নেতারা অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশগুলোতে গিয়ে কালো বাজারে কিনতেন মূল দামের দু’তিন গুণে। সেসবের কোনও নথিপত্রই আজ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আসলেই এই কালোবাজারে অস্ত্র কেনার ঘটনা কি সত্যি ঘটনা নাকি বসনিয়ানদের আবেগের থেকে উৎসারিত তা ঠিক জানিনা। তবে এটি সত্য যে সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে অস্ত্র সংগ্রহের অধিকার নিশ্চয়ই বসনিয়ার ছিল। সেটা মেনে নিয়ে যদি অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা শুরুতেই তুলে নেয়া হতো এবং যদি শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অনেক কঠিন অবস্থানে থাকত তবে হয়তো প্রানহানি অনেকাংশেই এড়ানো যেত।

গেল বেশ ক’ বছর ধরেই বেশ হৈ চৈ হচ্ছে অলিম্পিক বিশেষ করে শীতকালীন অলিম্পিকের স্থান নির্বাচন নিয়ে। পাশ্চাত্যের বহু গণতান্ত্রিক দেশের মানুষেরাই প্রতিবাদ করছেন তাদের দেশে বা শহরে অলিম্পিক আয়োজনের ব্যাপারে। এটি মূলত তারা করছেন এই ক্রীড়াযজ্ঞের বিশাল ব্যয় এবং অপচয়ের কথাটি মাথায় রেখে। সে যাকগে, যে জন্যে এই শীতকালীন অলিম্পিকের কথাটি তুললাম সেটি হল এযাবতকালে যে যে শহরে এই অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছে তার তালিকায় চোখ বুলালে দেখা যাবে তার প্রায় সবগুলোই শিল্পোন্নত ধনী দেশে অবস্থিত। ব্যাতিক্রম কেবল একটি সালে। সালটি ছিল ১৯৮৪। সেবছর যুগোস্লাভিয়ার সারায়েভো সুযোগ পায় এই অনুষ্ঠান আয়োজনের। এটি মূলত যুগোস্লাভিয়ার সামনে একটি সুযোগ নিয়ে আসে বাকি বিশ্বকে জানাবার যে তারাও পারে শিল্পোন্নত দেশগুলোর মতো সফল ভাবে এমন একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে। বেশ জাঁকজমক ভাবেই সফলতার সাথে শেষ হয় সে অলিম্পিক। দেশ বিদেশের খেলোয়াড়রা সাথে নিয়ে যান সারায়েভোর সাথে তোলা তাদের হাস্যজ্বল ছবি। কিন্তু কে জানতো এর মাত্র আট বছর পরেই এই ভ্যেনুগুলোর একেকটি হয়ে উঠবে মাইন ফিল্ড? আগাছায় ডুবে গিয়ে আর অসংখ্য গ্র্যাফিটি বুকে নিয়ে সারায়েভো শহরের চারপাশের পর্বতে ছড়িয়ে থাকা এই ভ্যেনুগুলো আজও যেন জীবন্ত হবার প্রতীক্ষায়। এমনই এক স্টেডিয়াম দেখতে গিয়েছিলাম পরিচয় হওয়া এক বসনিয়ান যুবক এমাদের সাথে। ওর কাছ থেকেই জানলাম সারায়েভোবাসী অলিম্পিক কমিটির কাছে বেশ কৃতজ্ঞ তাদের এই স্টেডিয়ামটি মেরামত করে দেবার জন্যে। এই স্টেডিয়ামের এক পাশেই হল সারায়েভোর শিশু এবং মাতৃ-সদন। সেটির কথা বলতে গিয়ে এমাদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। হতাশায় ভরা নিস্ফল ক্রোধের সাথে ও বলে, “সার্বদের কিছুতেই না জানার কথা নয় যে এটি ছিল শিশুদের হাসপাতাল। তার পরও তারা বারবার বোমা হামলা চালায় এই হাসপাতালটিতে। সে সময় আমার বোনও কাজ করতো এই হাসপাতালে। ওর কাছ থেকে শোনা আরেক ঘটনা বলি তোমাকে। একবার ওদের জন্য ওষুধ সাহায্য পাঠানো হল জাতিসংঘ থেকে দেড় টনের একটি চালানে। ওরা সেই চালান খুলে পেল দেড় টন কেবল ম্যালারিয়ার ওষুধ। বোঝো তামাশা। যে সময় আমাদের দরকার ছিল জীবন-রক্ষাকারী ওষুধগুলো, সে সময়ে তারা পাঠিয়েছে ম্যালারিয়ার ওষুধ। জাতিসংঘের এমন হঠকারিতামূলক সাহায্য পাঠানোর নজির ভুরি ভুরি। আমি তো কেবল তোমাকে আমার বোনের কাছ থেকে শোনা একটি ঘটনার কথা বললাম”।

মার্শাল টিটা সড়কটি শহরের পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে দু’ভাগে ভাগ হয়ে শেষে গিয়ে মিসেছে ওই মিলেস্কা নদীর ধারেই। সেই সন্ধিস্থলের জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কোন পথটি ধরা যায়, ডানদিকেরটি নাকি বাঁ দিকেরটি। শেষ মেশ বাঁ দিকের রাস্তাটি ধরেই এগুতে থাকলাম। সময়টা যদি হয় সকালের দিক তবে এই বাঁ দিকের “মুলা মুস্তাফে” সড়ক ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে হাতের ডানেই হয়তো চোখে পরবে লোহার এক বিশাল ছাউনির নিচে রং বেরঙের ফলফুল আর সবজি সাজিয়ে বসেছেন দূর-দুরান্ত থেকে আসা চাষিরা। আপেল, কমলা, ম্যাল্বেরি, চেরি এসব ফলমূল তো আছে এর সাথে আরও আছে চাষিদের ঘরে বানান নানা পদের জ্যাম আর জেলি। কেও কেও আবার সেই ছাউনির নিচে স্থান না পেয়ে মাটিতেই বিছিয়ে বসেছেন সাথে আনা লেটুস আর বুনো শাক। কিন্তু যে জন্যে এই বাজারের কথা লিখতে বসলাম তা এর রূপ, রস, গন্ধের জন্যে নয়। বরং এই বাজারকে ঘিরে একটি বিয়োগান্তক ঘটনার জন্যে। ১৯৯৫ সালের আগস্ট মাসের এক সকাল। সারায়েভোবাসীদের অবরুদ্ধকালীন শেষ বছর সেটি। অবরুদ্ধ হলেও জীবন তো আর থেমে থাকেনা। সেই চলমান জীবনের প্রয়োজনেই সেদিন সকালেও বহু মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন এই সকালের বাজারে। হটাৎ আচমকা একটি মর্টারের শেল এসে পরে এই বাজারের উপর। গুনে গুনে তেতাল্লিশ জন মানুষ প্রাণ হারান সেদিনের সেই ঘটনায়। সার্বরা নাকি এমনই করতো। ওরা জানতো ঠিক কোথায় কোথায় লোক সমাগম হতে পারে, সে বুঝেই তারা গোলা ফেলত। এমনকি স্নাইপাররা নাকি পথ চলতি মানুষদের দিয়ে এক খেলত এক নির্মম খেলা। যেমন, কোনও স্নাইপারের নাগালের মাঝে কেও এলেই অনেক সময় সে তাকে সে তাকে প্রাণঘাতী গুলি করত না। বরং গুলি করতো হাতে বা পায়ে, যাতে করে তাকে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসে আরও কয়েক জন। তখন পাখি শিকারের মতো করে সেই স্নাপার গুলি চালাত সবার উপরেই। এ যেন এক ফাঁদ পেতে শিকার করার মতোই ব্যাপার।

এই মার্কেট স্কোয়ারে বোমাবর্ষণের ঠিক মাস খানেক আগেই ঘটেছিল আরেকটি রোমহর্ষক মর্মন্তুদ ঘটনা। সারায়েভো থেকে পাঁচ-ছ’ ঘণ্টা দূরে পূর্ব বসনিয়ায় এক ছোট্ট গ্রামের নাম সেব্রেনিতস্কা। সে সময় এখানে ছিল ডাচ সেনাদের একটি শান্তিরক্ষী-বাহিনী ঘাঁটি। আশপাশের গ্রামে যখন সার্ব আক্রমণ অত্যাসন্ন হয়ে পরে তখন প্রায় পাঁচ–ছয় হাজার মুসলিম নারী-পুরুষ শিশু এসে আশ্রয় নেয় এই ঘাঁটির চত্বরে। কিন্তু মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে সার্ব সামরিক নেতা রাতকো ম্লাদিচ সেখান থেকে এই নিরস্ত্র ভয়ার্ত সাধারণ মানুষদের ডাচ সেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। অল্প সময় পরেই নারীদের থেকে পুরুষদের আলাদা করে পুরুষদের নিয়ে যাওয়া হয় নিকটস্থ এক স্কুল ঘরে। ব্রাশ ফায়ারের গুলিতে সেদিন সেই স্কুল ঘরে খুন করা হয় প্রায় পাঁচ হাজার মানুষকে। দুর্ভাগ্য এই যে, এই সুবিশাল গণহত্যার স্থানটি এখন পড়েছে সার্ব নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল, রিপাবলিক অফ স্পারস্কায়। তাই যুদ্ধের পর অনেক আলামতই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, এমনকি গণহত্যার স্থানগুলো মুছে দেবার জন্য বৃহৎ গণকবর থেকে দেহাবশেষ তুলে বিক্ষিপ্ত ভাবে বিভিন্ন ছোট ছোট গনকবের ফেলা হয়। এ কারণে যুদ্ধের প্রায় বিশ বছর পরও সমস্ত শহীদদের সম্পূর্ণ দেহাবশেষ উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। হয়তো দেখা যায় কারও হাত মেলে এক কবরে, পাটি মেলে আরেক গনকবরে, বাকি অংশগুলো হয়তো আরও পাঁচ-সাতটি কবরে। তবে হাল ছাড়েনি বসনিয়ানরা। সারা বছর জুড়ে তারা বিভিন্ন গণকবর থেকে দেহাবশেষ সংগ্রহ করে। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে যেকয়টি কঙ্কাল পূর্ণতা পায়, সেগুলো তারা সমাহিত করে ১১ই জুলাই সেব্রেনিতস্কা দিবসে। এ বছরও শুনলাম প্রায় একশ জন শহীদের দেহাবশেষ সমাহিত করা হবে। অর্থাৎ প্রতি বছরই ১১ই জুন তারিখে এই শহীদদের কফিনগুলো বসনিয়ার মানুষদের চোখে পুণরায় অশ্রু ঝরায়, প্রিয়জনদের বুকে নতুন করে শোকের মাতম তোলে।

মার্কেট স্কয়ারে বোমাবর্ষণ আর সেব্রেনিতস্কায় গণহত্যা এই দুটি ঘটনার পরই মূলত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নড়েচড়ে বসে। শুরু হয় সার্ব সামরিক অবস্থানগুলোতে ন্যাটোর বিমান হামলা। মাত্র পনের দিনের বিমান হামলাতেই সার্বদের কৌশলগত সামরিক অবস্থানগুলো ধবংস হয়ে যায়, তারা বাধ্য হয় আমেরিকার ডেটন শহরের বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে স্থাপিত আলোচনার টেবিলে আসতে। মূলত ক্লিনটন সরকারের আন্তরিক উদ্যোগের ফলেই সব পক্ষকে নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়। সেজন্য বসনিয়ার অনেকেই ক্লিনটন সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে সেই সাথে তাদের ক্ষেদও কম নয় শান্তিপ্রক্রিয়ার এই পুরো ব্যাপারটি নিয়ে। তাদের কথা হল মাত্র পনের দিনেই যদি সার্ব অবস্থান গুঁড়িয়ে দেয়া যায় তবে এই বল প্রয়োগের উদ্যোগ আরও চার বছর আগেই নেয়া হলনা কেন?

পরদিন সকালে বাস্কারসিয়া বাজারে যখন এসে দাঁড়ালাম তখনও সেই তিনশ বছরের পুরনো বাজারটি পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। বাজারে ঢোকার মুখে ইট বেছান খোলা চত্বরে কেবল ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর সকালের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছে। দু’ চারটে দোকানের দোকানিরা অবশ্য এরই মাঝে কাঠের পাল্লা খুলে ভেতরের জিনিসপত্র বাইরে এনে রাখতে ব্যাস্ত। তবে আর সব দোকান নাই খুলুক, ধূমায়িত চায়ের দোকানগুলো কিন্তু এরই মাঝে বেশ জমে উঠেছে। সে দৃশ্য দেখে নিজের চায়ের তেস্তাটিকেও সংবরণ করা কঠিন। এমনই একটি দোকানে ঢুকে বেশ সময় নিয়ে নিজের চায়ের কাপটি যখন শেষ করলাম ততক্ষণে আরও বেশ কিছু দোকান কপাট খুলে বাইরের ক্রেতাদের আহ্বান জানাচ্ছে, “ভেতরে এসে একবার ঢুঁ মেরে দেখুনই না। কিনতে চাইলে কিনবেন, না কিনলেও সমস্যা নেই। তারপরও অন্তত দোকানের ভেতরটা একবার দেখে যান”। এমনই এক দোকানির ডাকাডাকিতে ভেতরে ঢুকে আমার অজানা এক বলকান বাদ্যযন্ত্রের সাথে পরিচয় ঘটল। বলকান অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় এই বাদ্যযন্ত্রটির নাম গুসলে। এ দেখতে অনেকটা আমাদের একতারার মতোই। শুধু পার্থক্য এই যে এ যন্ত্রে বেহালার মতোই সুর সৃষ্টি করা হয় একটি বো দিয়ে। বেশ কম মূল্যে পাবার আশ্বাস পাবার পরও এটি কেনার ইচ্ছে থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে হল। কারণ যন্ত্রটির আকার নেহায়ত ক্ষুদ্র নয়, আমার যে এদিকে আরও বেশ খানিকটা পথ চলা বাকি। দোকানিকে তাই “কোয়ালা” অর্থাৎ ধন্যবাদ বলে বেরিয়ে এসে অনুসরণ করলাম এক নিরবছিন্ন ঠুক ঠুক শব্দের। শব্দটি আসছিলো এ গলিরই অন্য কয়টি দোকান থেকে। এ দোকাগুলোর দোকানিরা আসলে নিজেরাই কারিগর, নিজেরাই বিক্রেতা। বিক্রি-বাটাবিহীন অলস সময়ে তারা ব্যাস্ত থাকে ঠুক ঠুক শব্দে তামা আর সিলভারের তৈজসপত্রে নানা নকশা অঙ্কনে। তবে শুধু তৈজসপত্রই না, এ বাজারে আরও মেলে তুর্কী ঝলমলে কাপড়ের উপর বসনিয়ান মেয়েদের সূচিকর্ম করা নানা পদের চাঁদর। বাজারের দোকানগুলো দেখে কিছুটা ধন্দে পরে যাওয়া স্বাভাবিক, কারণ প্রায় সকল দোকানের ভেতরের অঙ্গসজ্জা প্রায় একই। আর তাই বাজারের অসংখ্য গলি-উপগলির মাঝে পথ হারানোটিও বিচিত্র কিছু নয়। তবে সে নিয়ে বিশেষ ভাবনা নেই। কারণ পথ হারালে পথের নিশানা দিতে পারে বাজারের উত্তর কোণের ‘গাজি হুস্রেভ বেগ’ মসজিদের মিনার, অথবা দক্ষিণের শতাব্দী প্রাচীন “সারায়েভো ব্রিউয়ারি”র উঁচু চিমনী থেকে নির্গত হওয়া সাদা ধোঁয়া।

সেই সাদা ধোঁয়াকে নিশানা রেখে উত্তর-পশ্চিমে এগুতেই নদীর ঠিক পাড়ে একটি হলদে-লাল রঙ্গে রাঙান সুবিশাল এক অট্টালিকা নজরে এলো। আশেপাশের আর বাদবাকি ভবনগুলো মাঝে এই ভবনটি একটি বিশেষ কারণে স্বতন্ত্র। কারণটি হল আশেপাশের আরও কোনও ভবনেই অধুনা রঙের প্রলেপ দেয়া হয়নি, বুজে দেয়া হয়নি বুলেটের ক্ষতগুলো। সেদিক দিয়ে এই ভবনটির এই বাড়তি পরিচর্যা পাবার কারণ হল এই ভবনটি বসনিয়ার জাতীয় গ্রন্থাগার। যুদ্ধের সময় সার্বদের ছোড়া মর্টারের শেলের আগুনে পুড়ে গিয়েছিলো এই গ্রন্থাগারের প্রায় পনের লক্ষ বই, হাজার হাজার দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি। তারপর প্রায় বিশ বছর লেগে যায় এই গ্রন্থাগারটি সংস্কার করে আবারও জনসাধারণের জন্যে খুলে দিতে। তবুও একটি বিষয় নিশ্চয়ই প্রণিধানযোগ্য যে, এই এলাকার খুব কাছেই অবস্থিত বসনিয়ার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ভবনগুলো কিন্তু এখনও সেভাবে সংস্কার করা হয়নি, এখনও সেগুলোর সম্মুখভাগে চোখে পরে বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া কংক্রিটের বিবর্ণ দেয়াল। সেখানে প্রায় বিশ বছরের চেষ্টায় এই গ্রন্থাগার ভবনটিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে পুরনো রূপে, এ কি বসনিয়ানদের শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগের জন্য নয়?

যুদ্ধের আগে যুগোস্লাভিয়ার যে শহরে সব চেয়ে বেশি প্রচলন ছিল আন্তঃধর্মীয় বিয়ের, সে শহরটি হল সারায়েভো। এখনকার সারায়েভো সমাজে শুনেছি সেসব দূরে থাক, ভিন্ন ধর্মের শিশুরাও নাকি যায় আলাদা আলাদা স্কুলে। সার্ব কিংবা ক্রোয়াটদের কথা তেমন জানিনা, তবে বসনিয়ান মুসলিমরা যে ধর্মের দিকে বেশ ঝুঁকছেন সে সারায়েভোতে এলেই কিছুটা অনুমান করা যায়। গত বিশ বছরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সাহায্যের বাতাবরণে আগমন ঘটেছে বিপুল পরিমাণ অর্থের, যার একটি বড় অংশই আসলে ব্যয় হয়েছে এই ধর্মীয় জোশ সৃষ্টির পেছনে। সারায়েভোর সবচেয়ে বড় মসজিদটি আজ সৌদি অর্থায়নে নির্মিত, মোস্তার থেকে সারায়েভো আসার পথে যে অসংখ্য নবনির্মিত মসজিদ চোখে পড়ে সেগুলোও মধ্যপ্রাচ্যের অর্থায়নে নির্মিত। আর এখানেই হল শঙ্কার কারণটি। বসনিয়ার সমাজে যদি মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় কট্টরপন্থা একবার পাকাপোক্ত জায়গা করে নেয় তবে অতীতের ক্ষতকে ভুলে গিয়ে ভবিষ্যতকে আলিঙ্গন করার স্বপ্ন হবে সুদূর পরাহত।

আন্তঃধর্মীয় বিয়ের কথা উল্লেখ করেছিলাম অন্য একটা বিষয় মনে পরে যাওয়ায়। সারায়েভো যুদ্ধে সার্বদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কিন্তু সবাই যে বসনিয়ান মুসলিম ছিলেন তা নয়। এ যুদ্ধে বসনিয়ান পক্ষের যোদ্ধাদের সতের ভাগ আসলে ছিল সার্ব। ধারণা করি এদের বেশির ভাগই হয়তো এসেছিলো এই মিশ্র পরিবারগুলো থেকে, যাদের কারও বাবা হয়তো সার্ব কিন্তু ওদিকে মা বসনিয়ান মুসলিম। তবে সেসব ছাপিয়েও কেন পাশাপাশি বাস করা এই জাতিগুলোর মাঝে এই দ্বেষ হটাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তা আমাকে ভাবায় কেবল। এই দ্বেষ তো কেবল কয়েক মাস অথবা কয়েক বছরে গড়ে উঠতে পারেনা, যদিনা তার বীজ বোনা থাকে অর্ধ কিংবা পূর্ণ শতাব্দী পূর্বে। সেই ‘গাজি হুস্রেভ বেগ’ মসজিদের আধ মাইল দূরে অবস্থিত সারবিয়ান অর্থোডক্স চার্চ আর ক্যাথলিক চার্চ ঘুরতে গিয়ে আর তাদের প্রতিষ্ঠাকালের সময় জানতে গিয়ে এ ব্যাপারে কিছুটা যেন আলো পেলাম।

ক্যাথলিক চার্চের সম্মুখ ভাগের দুটো চুড়োর দেয়ালে লাগানো দুটো ঘড়িতেই তখন বাজে ঠিক সাড়ে চারটে। প্রবেশ পথের লোহার দরজার একটি পাল্লা ঈষৎ খোলা। ভেতরের আধো আলো আধো অন্ধকার ঠেলে কিছুটা সামনে এগিয়ে বেদীর কাছে দেখতে পেলাম এক তরুণ যাজক বাইবেলের পাতা থেকে বাণী পড়ে শোনাচ্ছেন সামনে উপবিষ্ট জনা কয়েক শ্রোতাকে। স্লাভিক ভাষা তো আর আর জানা নেই, তাই যাজকের কথা বোঝার চেষ্টা করাই বৃথা। ভেতরের কিছু ছবি তুলে তাই পা চালালাম অর্থোডক্স গির্জার দিকে। কিন্তু অর্থোডক্স গির্জাটির দ্বার রুদ্ধ, অন্য সময়েও এটি সর্বসাধারণের জন্যে খোলা থাকে কিনা কে জানে। যাকগে, সারায়েভো শহরের প্রধান এই গির্জাদুটির প্রতিষ্ঠাকালের সময়ের কথা বলছিলাম। সারায়েভো শহরে বহু শতাব্দী ধরেই সার্ব এবং ক্রোয়াটদের বসবাস হলেও এই দুটো গির্জাই কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয় আঠার শতকের শেষ দিকে, অটোমান শাসনামলের শেষ পর্যায় তখন। বিষয়টি চিন্তা উদ্দীপক, তবে কি আগের শতাব্দীগুলোতে বৃহৎ গির্জা তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা ছিল? থাকাটা বিচিত্র নয়, এমনকি এই অর্থোডক্স গির্জাটি তৈরির সময় বেশ ভালো রকম প্রতিরোধ আসে সারায়েভোর কট্টরপন্থী একটি মুসলিম অংশ থেকে। তাদের কথা ছিল এই গির্জার চুড়ো কিছুতেই মসজিদের মিনারের থেকে উঁচু হতে পারবেনা। যদিও শেষমেশ একদিন গির্জার উদ্বোধন হয় বেশ বেশ টানটান এক অবস্থার মধ্য দিয়ে। অটোমান শাসনামলের তিনশ বছরে বসনিয়ান এবং ক্রোয়াটরা রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দিক দিয়ে এমনই বেশ কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। সেই অবস্থা থেকে জন্ম নেয়া ক্ষোভ আর দ্বেষই হয়তো পরবর্তীতে সঞ্চালিত হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

ঘুরতে ঘুরতে বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিলো। কাছেই এক বেকারি পেয়ে ঢুকে পড়লাম সে দোকানে। “ক্রম্পির মেদালিও” নামটি বেশ খটমট মনে হলেও এ নামের খাবারটি মুখে দিয়ে বুঝলাম এ আসলে আমাদের ওই আলুর চপ ছাড়া আর কিছু নয়। না, প্রক্রিয়াজাতে হয়তো কিছু পার্থক্য থাকতেই পারে। তবে স্বাদ অনেকটা তেমনই। ওই খেতে খেতে আর বসনিয়ার সুস্বাদু এক টুকরো মারমালেড-চকোলেট কেক প্যাকেটে পুরে বাইরের রাস্তায় বেরিয়ে আবার যখন হাঁটছি ঠিক তখনই এক দুঃখিনী মা তার সন্তানের জন্য হাত পাতলেন। আমার দেয়া প্যাকেট খুলে যখন দেখলেন চকোলেট কেক তখন তার আনন্দ দেখে কে। সারায়েভোর পুরনো শহরের পথে পথে চোখে পরে এমনই অনেক অভাবী মানুষ, যাদের অধিকাংশই পঙ্গু অথবা শারীরিকভাবে অক্ষম। এককালের সেই সমাজতান্ত্রিক সময়ে এমন অবস্থা হয়তো ছিল অকল্পনীয়।

আবারও সেই মার্শাল টিটো সড়ক, তবে এবার হাঁটছি শহরের পুরনো শহর থেকে বেরিয়ে সারায়েভোর মূল আবাসিক এলাকা অভিমুখে। সারায়েভোতে এক সমস্যা হল এ শহরে দু রাস্তার সংযোগস্থলগুলোতে আতিপাতি খুঁজেও আমি কোনও সড়কের নাম লেখা সাইনবোর্ড খুঁজে পেলামনা। তাই এখানে পথ চেনার জন্য আশেপাশের স্থাপনাগুলোই ভরসা। এই যেমন এখন এই টিটো সড়ক আর কসেভ সড়কের কোণের ওক গাছে ছাওয়া পার্কটি দেখে বুঝলাম ঠিক পথেই হাঁটছি, কারণ সকালে যাবার পথে ট্রাম থেকেও এই পার্কটি চোখে পড়েছিল। পাশ দিয়ে যাবার বুঝলাম আসলে এককালে হয়তো এটি শুধুই পার্ক ছিল, কিন্তু আজ এটি সেই যুদ্ধের সময়ে নিহত শিশুদের সমাধিস্থল। সারায়েভো অবরুদ্ধকালীন সময়ে প্রায় ছয়শ শিশু প্রাণ হারায় বোমার আঘাতে বা স্নাইপারের ছোড়া গুলিতে, তাদের অধিকাংশকেই তাড়াহুড়োয় সমাহিত করা হয় এই পার্কের ঢালু অংশটিতে। তাদের স্মরণে পার্কের এক কোণের স্মৃতিস্তম্ভে খোদাই করে লেখা আছে সেই হতভাগ্য নিস্পাপ শিশুদের নাম।

টিটো সড়ক ধরে চলে এলাম বেশ খানিকটা পথ। এটিকে সারায়েভোর মূল আবাসিক এলাকা বলা চলে। যুগস্লাভ সময়ে এ এলাকায় নির্মিত হয়েছিলো গগনচুম্বী বেশ কিছু আবাসিক ভবন। যুদ্ধের সময়ে এই ভবনগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সার্ব স্নাইপারদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তুতে, কারণ এই ভবনগুলোতে মূলত ছিল বসনিয়ান মুসলিমদের বসবাস। যুদ্ধের পরও নাকি প্রায় দশ বছর এই ভবনগুলো খাঁ খাঁ করতো, তারপর আস্তে আস্তে ফিরে আসা মানুষরা আবার বসবাস শুরু করে এই ভবনগুলোতে। তাকিয়ে দেখে বুঝলাম প্রতিটি ভবনের প্রতিটি জানালাই নতুন করে বসানো। কোনও কোনও তলের কোনও কক্ষের হয়তো পুরো দেয়ালটাই ধ্বসে গিয়েছিলো বোমার আঘাতে, যা এখন দৃষ্টিকটুভাবে কিছু ইটের প্রলেপ দিয়ে ঢাকা। আর এখানে সেখানে ভারী গুলির ছাপ তো আছেই। বুঝতে অসুবিধে হয়না এখানকার অধিবাসীরা জীবনধারণের উপযোগী টুকটাক মেরামত করে উঠে গেছেন এই এপার্টমেন্টগুলোতে। কিন্তু ভবনগুলো ওই আগের জৌলুস ফিরে আর ফিরে পায়নি। পাবার কথাও নয়। কারণ বসনিয়ার অর্থনীতির চাকা এখনও অনেকটাই শ্লথ। এ ব্যাপারে মুগদিবের সাথে কথা বলেছিলাম। মুগদিব শিক্ষিত, স্মার্ট, লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যাবসায়ি। তাই ভাবলাম মুগদিবের কাছ থেকে এ ব্যাপারে একটা সমসাময়িক ধারণা পাওয়া যাবে। তো মুগদিবের কাছ থেকে মূল কারণটা যা জানলাম তা হল এই- এখনকার বসনিয়ায় রাষ্ট্রপতি মূলত তিন জন। এক ক্রোয়াট পক্ষের, একজন বসনিয়ার মুসলিম পক্ষের এবং তৃতীয় জন সার্ব পক্ষের। এই তিন জনের একজন পালা করে আট মাসের জন্যে রাষ্ট্রপতি-সভাপতি হন। সমস্যা হল যেকোনো সরকারী গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এই তিনজনের মতৈক্যের ভিত্তিতে নিতে হয়, যা কিনা অধিকাংশ সময়েই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। আর তাই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এই দেশের সকল ক্ষেত্রে প্রবলভাবে বিরাজমান। শুধুমাত্র স্থানীয় সরকার ব্যাবস্থাই নাকি বারটি ভাগে বিভক্ত। আর তাই সমন্বয়হীনতা এবং মাথাভারী প্রশাসন নিয়েই চলতে হচ্ছে এদেশের সরকারী ব্যাবস্থাকে। ওদিকে আবার বসনিয়ার মোট চাকুরীজীবীদের শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগই নাকি কাজ করে সরকারী দপ্তরগুলোতে। আর তাই সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয় এই প্রশাসন চালাতে। মাথা দুলিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে মুগদিব বলছিল, “আমরা বলতে পারো এক ধরণের জোড়াতালি দিয়ে চলছি আর কি, তবে এ ভাবে কতো দিন চলবে সেটাই হল প্রশ্ন।“

ওই এলাকাতেই আশপাশের ভবনগুলোর সাথে একেবারেই বেমানান ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙের ‘হলিডে ইন’ হোটেলের বহুতল ভবনটি বানানো হয়েছিলো সেই সারায়েভোর শীতকালীন অলিম্পিকের সময়। তার ঠিক আট পর বছর লিপ ইয়ারের সাল ১৯৯২ এর ২৯ এ ফেব্রুয়ারী বসনিয়ার সংসদে প্রস্তাব তোলা হয় স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্ম-প্রকাশের জন্যে। কিন্তু বেঁকে বসেন সার্ব জাতিয়তাবাদী নেতা রাদভান কারাদাভিচ। সংসদ বর্জন করে রাদভান তার দলবল নিয়ে এসে ওঠেন এই হলিডে হোটেলে, সেখান থেকেই করতে থাকেন সাংবাদিক সম্মেলন এবং নেতৃত্ব পরিচালনা। ওদিকে সারায়েভোর পথে পথে তখন স্বাধীনতাপন্থীদের উত্তাল বিক্ষোভ। তাদের সবার ক্ষোভ এই রাদভানের উপর। অবস্থা চরমে রূপ নেয় যখন এপ্রিলের এক দিনে এই বিক্ষোভকারীরা তাদের প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় এই হলিডে হোটেল অভিমুখে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল হোটেলে অবস্থান নেয়া রাদভানের রাজনৈতিক সাঙ্গপাঙ্গের প্রতি বিক্ষোভ দেখানো। কিন্তু হোটেলের ভেতরে যে তখন সার্ব অনুগত স্নাইপারদের অবস্থান ছিল তা তাদের জানা ছিলনা। গুলির আঘাতে বেশ কিছু নিরস্ত্র বিক্ষোভকারী লুটিয়ে পরে হোটেলের সামনের চত্বরেই। এই ঘটনাটিই সূচনা করে পরবর্তী চার বছরব্যাপী বসনিয়া যুদ্ধের। সেদিনের সেই রক্তপাতের পর রাদভান দলবল নিয়ে পালিয়ে যায় সারায়েভোর পাশের এক পাহাড়ে, সেখান থেকেই সে পরবর্তীতে যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে। যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হলে এই হোটেলটি হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম কর্মীদের প্রধান জমায়েত এবং আবাসস্থল। আর তাই সেসময়কার রনাঙ্গন থেকে সাংবাদিকদের পাঠানো বিভিন্ন ভিডিও চিত্রে স্থান পেয়েছে এ হোটেলের লবি, কক্ষ, ব্যাল্কনি কিংবা সম্মুখভাগ।

কপালের ভুরু জোড়া ঈষৎ কুঞ্চিত, হাত দুটো পিছমোড়া করে মুষ্টিবদ্ধ, সামরিক পোশাকের উপর লম্বা ভারী ওভারকোট গায়ে জড়িয়ে কি যেন এক গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন মাটির পানে। তিনি যুগোস্লাভিয়ার এক সময়ের দাপুটে নেতা টিটো। আর তার এই প্রতিমূর্তিটির অসংখ্য কপি পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে স্থাপন করা হয় সারা যুগোস্লাভিয়া জুড়ে। সমজাতন্ত্রের পতনের পর যার অধিকাংশই অপসারণ করা হয়। তাই সারায়েভোতেও যে টিটোর সেই প্রতিমূর্তির দেখা পাব ভাবিনি, তায় আবার সেটা কিনা স্থাপিত সারায়েভো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে। ওক আর পাইন গাছে ছাওয়া এই ক্যাম্পাসটি যুদ্ধের আগে যদিও ছিল যুগোস্লাভ ফেডারেল সামরিক বাহিনীর ব্যারাক। সেই ‘হলিডে ইন’ হোটেলের দু ব্লক দূরেই ছিল এ ব্যারাক। ৯২ এর ফেব্রুয়ারিতে যখন বসনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে তখনও সারায়েভোতে বসে ছিল এই ফেডারেল বাহিনী, যেহেতু ফেডারেল সরকার তখনও বসনিয়ার এই স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি। কিন্তু অচিরেই এই প্লাটুনের সৈনিকরা বুঝতে পারে তারা আসলে ফাঁদের ইঁদুর। তাদের একদিকে সার্ব মিলিশিয়া বাহিনী, অন্যদিকে বসনিয়ান মিলিশিয়া বাহিনী। তারা বুঝে যায় প্রাণ নিয়ে বেলগ্রেডে ফিরে যাওয়াটাই সর্বোত্তম পন্থা। কিন্তু সে পথও তেমন সহজ নয়। কারণ এই ব্যারাকটি সারায়েভোর তখনকার মুসলিম নিয়ন্ত্রিত এলাকার একেবারে মাঝখানে। এখান থেকে পালাতে গেলে পথেই মারা পড়তে হবে। এই প্লাটুনের কমান্ডার তাই মরিয়া হয়ে একদিন কুটচালে জিম্মি করলেন তখনকার বসনিয়ান মুসলিম রাষ্ট্রপতি আলিয়া ইসেবেগভিচকে। শর্ত হল তারা রাষ্ট্রপতিকে মুক্ত করে দেবে যদি তাদের প্লাটুনকে নিরাপদে সারায়েভো ছেড়ে যেতে দেয়া হয়। সেদিনের সেই জিম্মি নাটকের অবসান হয়েছিলো কোনও অঘটন ছাড়াই, দাঁতে দাঁত চেপে বসনিয়ান গেরিলারা ফেডারেল বাহিনীর এই নিরাপদ প্রস্থান মেনে নিয়েছিল। যুদ্ধের পর সেই পরিত্যাক্ত ব্যারাককে বানানো হয় সারায়েভো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস।

কিন্তু প্রশ্ন হল যেখানে সার্বিয়া এবং ক্রোয়েশিয়ার অনেক প্রকাশ্য স্থান থেকেই টিটোর প্রতিমূর্তি অপসারণ করা হয়েছে সেখানে কি করে সারায়েভোর এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে টিটোর মূর্তির বেদিমূলে এখনও শোভা পায় কারও রেখে যাওয়া শুকনো টিউলিপের গুচ্ছ? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি বসনিয়ার প্রায় সবার কাছ থেকেই অভিন্ন উত্তর পেয়েছি। প্রায় সবাই এক বাক্যে বলেছেন, “টিটোর সময়ে আমাদের আর যাই না থাকুক, ছিল স্বস্তি, ছিল নিরাপত্তা। আমাদের এই জাতিগত হানাহানিও ছিলনা। ইস্টার, রমজান, ক্রিসমাস আমরা সবাই এক সাথে উদযাপন করতাম। বেশ ভালোই তো ছিলাম আমরা। সব গণ্ডগোল তো শুরু হল টিটোর মৃত্যুর পর থেকে”। বিশেষত প্রবীণ প্রজন্মের মাঝে টিটো এখনও ভালোই জনপ্রিয় ব্যাক্তিত্ব। আরেকটা বিষয় খেয়াল করলাম যে ডেটন চুক্তির জন্যে ক্লিন্টনকে অনেকে পছন্দ করলেও টিটোর মৃত্যু পরবর্তী যুগোস্লাভিয়ার ভাঙ্গন এবং তদপরবর্তী ঘটনা প্রবাহের জন্যে বসনিয়ার অনেকেই আবার অভিসম্পাত করে বসেন আমেরিকাকেই।

পরদিন দুপুরে আমার সারায়েভো বিমানবন্দর থেকে বেলগ্রেডগামী প্লেন ধরার কথা। বিমানবন্দরে যাবার আগে হাতে বেশ কিছুটা অবসর সময়। ভাবলাম এই সময়টা মুগদিবের মায়ের সাথে গল্প করে কাটিয়ে দেই। বুড়িও মনযোগী শ্রোতা পেয়ে খুলে বসলেন তার গল্পের বাক্স। সেই বাক্স থেকে কখনও বেড়িয়ে এলো যুদ্ধকালীন এই পরিবারটির সংগ্রামের কথা, কখনও তার নাতনীর কথা, কখনও নেদারল্যান্ডে ফেলা আসা তার মেয়ের কথা, আবার কখনও অসময়ে তাকে ফেলে পরপারে পাড়ি জমানো মুগদিবের বাবার কথা। এই শেষ গল্পটি বলার সময় বৃদ্ধা তার ছলছল চোখ আড়াল করার জন্যে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন পাশের বাগান আর এবড়ো খেবড়ো মাঠের পরে শুরু হওয়া দূরের পাহাড়শ্রেণীর দিকে। ধরা গলায় বলছিলেন, “বুড়োটা বড় আশা করতো একদিন যুদ্ধ শেষ হবে, আমরা বলকানে ফিরব, ফিরে পাব এক শান্তিময় অবসর জীবন। কিন্তু কোথায় কি? দেশ ছেড়ে যে কটা বছর বাইরে ছিলাম সে কটা বছর বুড়ো হাড় ভাঙা খাটুনি তো করতোই, বসনিয়ায় ফিরেও তো বেচারা শান্তি পেলনা। অবসর জীবনের দেখা পাবার আগেই তিন বছর আগে একদিন দুম করে চলে গেল আমাকে ফেলে”। স্বজনকে হারানোর এমন হাহাকার আর বেদনা আজ বসনিয়ার ঘরে ঘরে।

কিন্তু তারপরও থেমে নেই মানুষের জীবন। যাপিত জীবনের অমোঘ নিয়মেই অতীতের সব বেদনা আর হতাশাকে সময়ের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে বসনিয়ার তিনটি গোষ্ঠীর মানুষই এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এখনও যে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মেঘ বসনিয়ার আকাশকে ঢেকে রেখেছে তার দূরীভূতকরণ সম্ভব একমাত্র এ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পক্ষেই। পুরনো প্রজন্মগুলোর এ দেশকে নতুন করে দেবার মতো আর কিছুই নেই। আর তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি নতুন স্বপ্ন, নতুন ভাবনা আর বিভেদমুক্ত মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে তবেই হয়তো একদিন আবারও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে বসনিয়ার সেই হারিয়ে যাওয়া সোনালি দিনগুলোকে।


Comments

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

প্রিয় জীবনযুদ্ধ,
কোনও কারণে কি লেখাটি মুছে গেছে? না আমিই দেখতে পাচ্ছিনা? একটু দেখবেন? ইয়ে, মানে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

জীবনযুদ্ধ's picture

আমিও তো ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছিনা, আমিও লেখাটা দেখতে পারছিনা। মডুদের কেও সাহায্য করবেন?

জীবনযুদ্ধ's picture

সাক্ষী, সমস্যাটা মনে হয় ধরতে পেরেছি, এখন মনে হয় দেখতে পাবেন পুরো লেখাটা। ধন্যবাদ

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক's picture

অসাধারণ ভ্রমণ কাহিনী। হাততালি

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

জীবনযুদ্ধ's picture

ধন্যবাদ আপনাকে

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

এই পর্বটার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বেশ পরিশ্রম করেছেন। লেখা ছবি মিলিয়ে 'বসনিয়ার ডায়েরি' অনায়াসে ই-বুক হবার যোগ্যতা রাখে। সিরিজ শেষ হলে সেটা বিবেচনা করবেন।

হার্জ্জেগোভিনায় কি গিয়েছিলেন?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

জীবনযুদ্ধ's picture

হ্যা পান্ডবদা, মোস্তারে যাওয়া হয়েছিল, ওটা হার্জেগভিনাতেই পরেছে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

তাহলে মোস্তার পর্বে আমাদেরকে একটু জানান বসনিয়া আর হার্জ্জেগোভিনার মধ্যে নৃতাত্ত্বিক আর সাংস্কৃতিক অমিলগুলো কোথায়, মিলগুলোই বা কোথায়। কবে থেকে এই মাণিকজোড় তৈরি হলো, আর কেনই বা হলো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নজমুল আলবাব's picture

আপনার সাথে ঘুরছি। চলুক

জীবনযুদ্ধ's picture

ধন্যবাদ নজমুল ভাই

কল্পনা আক্তার's picture

অনেক যত্ন করে লিখেছেন তাই পড়তে এতো সাবলীল হয়েছে। চার বছরের শ্বাসরুদ্ধকর অনেক ঘটনাই আপনার লেখার মাধ্যমে পড়ে/দেখে ফেললাম মনে হচ্ছে। আপনার লেখাটি পড়তে গিয়ে বসনিয়া যুদ্ধের কিছু বিষয় বিস্তারিত পড়ছিলাম উইতি’তে সাথে গুগলের কল্যানে ছবিগুলোও সামনে পড়ে গেলো আর কিছুতেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। বারবার একটি কথাই মনে হচ্ছিল “আমরা এই মানুষরাই সৃষ্টির তৈরী সবচেয়ে নিষ্ঠুর প্রানী” মন খারাপ


........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা

জীবনযুদ্ধ's picture

আমার লেখা যে আপনাকে বসনিয়া সম্পর্কে আরও জানতে উৎসাহিত করেছে সেটা জেনে খুবই ভালো লাগলো, ভালো থাকবেন।

অনুসন্ধিৎসু's picture

ধন্যবাদ জীবনযুদ্ধ, আপনার চমৎকার ও সাবলীল লেখার জন্য। বসনিয়া ও হার্জ্জেগোভিনা সম্পর্কে আমার ছোটবেলা থেকেই ভীষণ আগ্রহ।বসনিয়া যুদ্ধ শুরুর সময় আমি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বিবিসি মারফত সেই যুদ্ধের বিভীষিকা সম্বন্ধে অবহিত হয়ে শিউরে উঠেছিলাম। বড় হয়ে ইন্টারনেট পেয়ে কতো যে ব্যাক্তিগত গবেষনা করেছি, কতো যে তথ্যচিত্র দেখেছি, কতো যে চলচ্চিত্র দেখেছি বসনিয়া যুদ্ধ সম্পর্কে তার ইয়ত্তা নেই। মনে মনে একটা পণ ও করেছি যে, যাবো একদিন এই বসনিয়া তে। আপনার লেখা পড়ে ( পড়তে পড়তে মনে হচ্চিলো, আপনি নন বরং আমিই যেনো ঘুরে দেড়িয়েছি) সেই পণটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। এই বিষয়ে আপনার কাছ থেকে আরো লেখার আশায় রইলাম।

জীবনযুদ্ধ's picture

ধন্যবাদ আপনার এই বিশাল মন্তব্যের জন্যে। হ্যা, ইচ্ছে আছে সমকালীন ঘটনা এবং যুগোস্লাভিয়া নিয়ে আরও কিছু লিখবার।

অতিথি লেখক's picture

ভাইতো বসনিয়া সম্পর্কে ধারণাই পাল্টে দিলেন।
আর এই অসম্ভব সুন্দর ছবিগুলোর জন্য ধন্যবাদ।

পিঙ্গল

রানা মেহের's picture

কী চমৎকার একটা লেখা! এরকম ডিটেইল লেখা পড়লে তৃপ্তি আসে, মনে হয় কিছু একটা পড়লাম।
জাতিসংঘের সাহায্যের নমুনা পড়ে বমি চলে এলো। আর এই নমুনা নিয়েই কত বাহাদুরি!

আচ্ছা বসনিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কীরকম? পরিবার নিয়ে ঘুরে আসা যাবে?

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

জীবনযুদ্ধ's picture

লং উইকেন্ডে শহরের বাইরে থাকায় আপনার মন্তব্যের জবাব দিতে একটু দেরী হয়ে গেলো। অন্তত বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলতে পারি পরিবার নিয়ে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে আসতে পারবেন, তেমন কোনো নিরপত্তা সমস্যা নেই.
ধন্যবাদ

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.