বসনিয়ার ডায়েরি- ০১

জীবনযুদ্ধ's picture
Submitted by jibonjudho [Guest] on Mon, 27/07/2015 - 1:44pm
Categories:


গাঢ় সবুজের ঢেউ খেলানো সারি সারি পাহাড়ের ঢল খাড়া গিয়ে নেমেছে তুঁতরঙা এক সাগরের পাড়ে। তীরের এই কাছটায় বড্ড শান্ত স্থবির যেন এই সমুদ্র। সবুজের গালিচা ঘেরা এই পাহাড়ের দল আর সেই পাহাড়ের পাদদেশে থম মেরে থাকা জমাট নীল সমুদ্রের এই চিত্রটি যে কোনও কৃত্রিম চিত্র নয়, বরং এই ধরাধামেরই কোনও কারসাজি সেটি বোঝাবার জন্য মাঝে মাঝে হুটহাট করে এই স্থবির সাগরের উপর ভেসে আসে এক ঝাঁক গাঙচিল পাখি। এই পুরো দৃশ্যপটটির মাঝে এই পাখির ঝাঁকটিই একমাত্র চলমান কোনও কিছু, বাদবাকি সবাই যেন গভীর ঘুমে ঘুমন্ত। কিঞ্চিৎ বোধ হয় সংশোধন প্রয়োজন এই কথাটির মাঝে। ওই পাখির ঝাঁকগুলোই শুধু নয়, সাগরের বহু ওপরে পাহাড়ের গা বেয়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে চলা আমাদের বাসটিও এই পুরো দৃশ্যপটটির অপর চলমান অনুষঙ্গ।

যে সাগরের কথা দিয়ে কথা শুরু করেছিলাম সেই অ্যাড্রিয়াটিককে বাঁপাশে রেখে আমরা চলেছি বসনিয়ার এক ছোট্ট শহর মোস্তারের পথে। প্রথমে যখন পরিকল্পনা করি ক্রোয়েশিয়া থেকে বসনিয়ায় যাব তখন ভেবেছিলাম জাগরেব থেকেই সরাসরি সারায়েভো যাব। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম শুধু সারায়েভোয় গেলে বসনিয়ায় যাওয়া হয় বটে, কিন্তু বসনিয়াই তো আর পুরো বসনিয়া নয়। সেই সাথে নিদেনপক্ষে হার্জেগোভিনাটায় না গেলে কিছুটা যেন অপূর্ণতা থেকে যায়। তাই শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম যাত্রাপথটাকে একটু দীর্ঘায়িত করে প্রথমে জাগরেব থেকে যাব ক্রোয়েশিয়ার প্রায় সর্ব দক্ষিণের শহর দুব্রভনিকে। সেখান থেকে হার্জেগোভিনার মোস্তার বাসে মাত্র তিন ঘণ্টার পথ।

বাংলাদেশের মানচিত্রেরে দিকে তাকালে দেখা যায় সর্ব উত্তরে এক জায়গায় এক সরু অঞ্চল প্রায় গিয়ে সেঁধিয়ে গিয়েছিলো নেপালের গায়ে, যদিনা বাঁধা দিতো ভারতের অল্প এক টুকরো ভূমি। এই ভূমিটুকুই ভারতের সম্বল পূবের আর সাতটি রাজ্যের সাথে গোটা পশ্চিমের সংযোগের জন্যে। কিন্তু ধরা যাক ওই স্থানটি যদি থাকত বাংলাদেশের মানচিত্রের ভেতরে? তবে গোটা ওই পূর্বের মানুষদের পশ্চিমে আসতে হতো কিন্তু বাংলাদেশের এক ছোট্ট অংশ পাড়ি দিয়ে। দুব্রভনিক, তথা ক্রোয়েশিয়ার দখিনের অ্যাড্রিয়াটিক পাড়ের কিছু এলাকা তেমনিভাবে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন বসনিয়ার অল্প কিছু এলাকা দিয়ে। আর তাই দুব্রভনিক থেকে মোস্তারে যেতে গেলে ক্রোয়েশিয়ার সীমান্ত আসলে পাড়ি দিতে হয় তিন বার। একবার ক্রোয়েশিয়া ছেড়ে বসনিয়ার সেই সরু ভুখণ্ডে ঢুকবার সময়, দ্বিতীয়বার সেই ভূখণ্ড ছেড়ে ক্রোয়েশিয়ায় পুনরায় ঢুকে, আর শেষবার হল পূবমুখী আরেক মহাসড়ক ধরে ক্রোয়েশিয়া থেকে বের হয়ে বসনিয়া-অভিমুখী সড়ক ধরবার সময়। এই এতো হ্যাপা যদি না থাকত তবে আমার মনে হয় এই পথটুকু হয়তো দু’ কি আড়াই ঘণ্টাতেও উতরে যাওয়া সম্ভব হতো।

পৃথিবীর যত দেশে গেছি তার মাঝে মনে হয় সব চেয়ে কম সময়ে পাসপোর্টে আগমন ছাপ্পড়টি মিলল এই বসনিয়ায় এসে। মোটামুটিভাবে সীমান্ত পুলিশ এক মিনিটেরও কম সময় নিয়ে ঝটপট বাসের ভেতরেই পাসপোর্টে সিল মেরে ত্বরিত নেমে গেলো।

হার্জেগোভিনাতে প্রবেশ করার পর প্রথম যে পরিবর্তনটি চোখে পড়লো তা হল মাইলের পর মাইল অনাবাদী ভূমি। এমন নয় যে এ ভূমি অসমতল, তবুও অনাবাদী বোধ করি কৃষকের অর্থনৈতিক অসামর্থ্য কিংবা এই পতিত জমিতে মাইনের বিপদ থেকে হবে। কারণ যতদূর জানি এতদঅঞ্চল থেকে এখনও পুরোপুরি সব মাইন অপসারণ করা সম্ভব হয়নি।

মোস্তারে পৌঁছুবার আগে আমাদের বাসটি একটা ছোট্ট যাত্রা বিরতি নিয়ে নিলো হার্জেগোভিনার কাপ্লিয়ানা শহরে। অবসন্ন দুপুরের সেই এলেমেলো বাসস্ট্যান্ডে আমাদের বাসটি ছাড়া আর অন্য কোনও বাস চোখে পড়লো না। কেবল সংলগ্ন এক মলিন পানশালায় দেখলাম কয়েক বুড়ো সিগারেট আর সস্তা বিয়ার ওড়াতে মশগুল। এই পানশালার ঠিক পরের এক টং ঘরের মতো দোকান থেকে জলের বোতল আর চিপস কিনে দাম দেবার সময় জানতে পারলাম সবসমেত আমাকে দিতে হবে দু’ মার্ক। ক্রোয়েশিয়ায় দেখেছিলাম এক ডলারের বিপরীতে পাওয়া যায় প্রায় ছ’ ক্রোয়েশিয়ান কুনা। বসনিয়ার অর্থনীতি যেহেতু আরও দুর্বল তাই আমি ভেবেছিলাম নিশ্চয়ই এখানে এক ডলারের বিপরীতে আরও বেশি বসনিয়ান মার্ক পাওয়া যাবে। সেই ভেবে আমার মাথায় হাত, এ কোথায় এলেম? তার মানে আধ ডলারেরও কমে জলের বোতল আর চিপস? পরে অবশ্য আমার ভুল ভেঙ্গেছিল, পরে জেনেছিলাম এই চিন্তার সূত্রটি ভুল। অর্থনীতির অবস্থা যাই হোক না কেন, মোদ্দা কথা হল এখনকার বাজারে এক ডলারে প্রায় দু’ বসনিয়ান মার্কের মতো পাওয়া যায়।

সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় নব্বই এর দশকে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সে যুদ্ধে যে শহরটি সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো সে শহরটি মোস্তার। হয়তোবা প্রাণহানির দিক দিয়ে সারায়েভো এগিয়ে আছে মোস্তারের আগে, কিন্তু যুদ্ধের সামগ্রিক ধকলের দিক দিয়ে সব চেয়ে বেশি ঝড় বয়ে গছে এই শহরটির উপর দিয়েই। কম সময় নয়, প্রায় বিশটি বছর পার হয়ে গেছে সেই যুদ্ধের পর। কিন্তু এখনও সেই বিভৎসত যুদ্ধের বহু পদচিহ্নই অবিকল রয়ে গেছে এ শহরের পথে পথে।

মোস্তার নিয়ে আরও কথা বলার আগে এখানে সংগঠিত যুদ্ধের পটভূমিকার, আর এই শহরের ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা দিয়ে রাখি। শুরুটা করা যাক ১৯৭৪ সাল থেকে। দাপুটে শাসক টিটোর শাসনামলের শেষ দিক তখন। বয়সের ভারে টিটো তখন অনেকটাই সঙ্গিন। নানা জাতিতে বিভক্ত যুগোস্লাভিয়ার আঞ্চলিক নানা নেতাদের চাপে টিটো ঘোষণা করলেন সংবিধান সংশোধন করবেন তিনি। নতুন সংবিধানে মোট ছয়টি প্রদেশ এবং দুটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল নিয়ে একটি নতুন সরকার ব্যবস্থার বিধান থাকবে। এই ছয়টি প্রদেশ হল স্লোভেনিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রো এবং ম্যাকেডনিয়া। আর দুটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হল ভয়ভদিনা এবং কসোভো। অনেকে বলেন এই ৭৪ এর সংবিধান পরিবর্তনটি ছিল যুগোস্লাভিয়ার আত্মহননের প্রথম ধাপ। ৮০ সালে টিটোর মৃত্যুর পর এই অঞ্চলগুলোর নেতাদের জাতীয়তাবাদী জোশ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যা পরের দশ বছরে উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে। সমজাতন্ত্রের পতনের পরপরই স্লোভেনিয়া বেরিয়ে যায় যুগোস্লাভিয়া থেকে। স্লোভেনিয়ার সেই বেরিয়ে যাওয়াটা মোটামুটি শান্তিপূর্ণই ছিল। বেরিয়ে যাওয়ার তালিকার দ্বিতীয় দেশটি ছিল ক্রোয়েশিয়া। সে নিয়ে সেই দেশের পূর্ব দিকে বেশ কিছু বড় রকমের সংঘর্ষ বেঁধে যায় তখনকার যুগোস্লাভিয়ার সাথে। ক্রোয়েশিয়ার এই পূর্ব দিকের এলাকার বেশ কিছু শহরে বড় ধরণের সার্ব বসতি ছিল। আর তাই ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা স্বাভাবিকভাবেই যুগোস্লাভিয়ার স্বার্থানুকুল ছিলনা যে যুগোস্লাভিয়ার ফেডারেল সরকারে মূলত কর্তৃত্ব ছিল সার্বদের। এর ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯২ সালের গ্রীষ্মে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা। যে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার কথা বলছি, সেখানে প্রায় কয়েকশ বছর ধরে তিনটি জাতির মানুষের বসবাস- ক্রোয়াট, সার্ব এবং মুসলিম। ক্রোয়াটরা ধর্মের দিক দিয়ে ক্যাথলিক খ্রিস্টান আর সার্বরা অর্থোডক্স খ্রিস্টান। বসনিয়ান মুসলিমরা মূলত অটোমানদের শাসনামলে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়। এই পুরো অঞ্চলে এই তিনটি জাতির মানুষের অবস্থান এমন ছিল যে হয়তো একটি গ্রাম সার্ব-প্রধান, পরেরটি ক্রোয়াট-প্রধান আবার হয়তো তার কয়েক গ্রাম পরের গ্রামটি মুসলিম প্রধান। কিন্তু মোটের উপর দেখতে গেলে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার পূবের অঞ্চলটি যেটি এখন পরিচিত রিপাবলিক অফ স্পারস্কা নামে, সেটি মূলত সার্ব প্রধান। মধ্যাঞ্চলের বসনিয়া মুসলিম প্রধান আর পশ্চিমের হার্জেগোভিনা- অর্থাৎ আমি ক্রোয়েশিয়া থেকে বসনিয়ার যে অঞ্চলে প্রবেশ করেছি সেটি ক্রোয়াট প্রধান। মোস্তার শহরটি এই পূর্বাঞ্চলের হার্জেগোভিনাতে প্রবেশের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান শহর। শহরের মাঝ বরাবর বয়ে চলা সবুজাভ নীল জলের এক নদী, নেরেৎভা যার নাম, এই শহরটিকে পূর্ব আর পশ্চিম এই দু ভাগে বিভক্ত করেছে। শহরের পূবের অংশটিতে মূলত মুসলিমদের বসবাস আর পশ্চিম দিকে মূলত ক্রোয়াটদের বসবাস। তবে বেশ কিছু সার্বও ছিল এই শহরে, তাদের বসবাস মূলত ছিল শহরের বাইরের দিকে।

স্বাধীনতা তো ঘোষণা করে বসলো বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কিন্তু সহসাই বোঝা গেলো এই অঞ্চলটি আসলে এতকাল বসে ছিল জাতিগত বিদ্বেষ আর অবিশ্বাসের এক বারুদের উপর। হৈ হৈ রব তুলে প্রথমেই তেড়ে এলো বসনিয়ান সার্বরা। কারণ বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সার্বদের ধারণা ছিল বসনিয়া স্বাধীন হয়ে গেলে সেই দেশে তারা হয়ে পরবে কোনঠাসা, আর মূল ক্ষমতার অধিকারী হবে বসনিয়ান মুসলিমরা। তাদের তাই ইচ্ছে ছিল এই বসনিয়া-হার্জেগোভিনাকে মূল যুগোস্লাভিয়ার সাথে রাখা। সেটি না অর্জিত হলে অন্তত নিজেদের জন্যে পৃথক স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল তৈরি করা। আর তাই যুদ্ধের দামামা যখন বেজে উঠলো তখন যুগোস্লাভিয়ার ফেডারেল সামরিক বাহিনীর সহায়তায় এই সার্বরাই প্রথমে ঝাঁপিয়ে পড়লো মোস্তারের মুসলিম এবং ক্রোয়াট উভয় গ্রুপের উপর। ব্যাপারটা অনেকটা আমাদের ৭১ এর মতোই, ৭১ এ যেমন পশ্চিম-পাকিস্তানি প্রধান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার নিরস্ত্র মানুষের উপর, অনেকটা সেভাবেই সার্ব-প্রধান যুগোস্লাভ ফেডারেল সামরিক বাহিনী দাঁড়িয়ে গেলো ক্রোয়াট আর মুসলিমদের বিরুদ্ধে। ও হ্যাঁ, বসনিয়ান ক্রোয়াটরাও কিন্তু বসনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষেই ছিল, তারা আবার সর্বাগ্রে ঘৃণা করে সার্বদের। সার্বদের কর্তৃত্বে যুগোস্লাভিয়ায় থাকার চেয়ে তারা স্বাধীন বসনিয়ায় থাকাটাই অধিকতর শ্রেয় মনে করে। আর তাই যুদ্ধের একেবারে শুরুতে ক্রোয়াট এবং মুসলিম দু’ দলই একে ওপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে নামে যুগোস্লাভিয়ার ফেডারেল বাহিনী এবং স্থানীয় সার্ব মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে। এ ফাঁকে আরেকটা কথা যোগ করে রাখি, এ পর্যন্ত কিন্তু সার্বিয়া দেশটির কোনও অস্তিত্ব ছিলনা। যে সময়ের কথা বলছি তখনও বলবৎ যুগোস্লাভিয়া, যে যুগোস্লাভিয়ায় তখনও টিকে আছে সার্বিয়া, কসোভো আর মন্টিনিগ্রো। এই যুগোস্লাভিয়ায় রাষ্ট্রপতি পদে তখন আসীন স্লভাদান মিলেশভিচ যিনি আবার একজন ডানপন্থী কট্টর সার্ব।

যুদ্ধ আর রাজনীতি এ দুটোতেই হয়তো শেষ বলে কিছু নেই। আজকের বন্ধুও যুদ্ধের ময়দানে হতে পারে কালকের শত্রু। অনেকটা সেভাবেই মোস্তার যুদ্ধের দাবার চাল একটু ঘুড়িয়ে দিলেন ক্রোয়েশিয়ার তখনকার রাষ্ট্রপতি তুজমান। সে সময়ে ক্রোয়েশিয়া পেছন থেকে সাহায্য করছিলো মোস্তারের ক্রোয়াটদের। যেহেতু যুগোস্লাভিয়া থেকে ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা মোটেই শান্তিপূর্ণ ছিলনা আর আগে থেকেই সার্ব-ক্রোয়াটদের মাঝে জাতিগত অবিশ্বাস এবং বিদ্বেষ বিদ্যমান ছিল তাই তাই বসনিয়া যুদ্ধে ক্রোয়েশিয়ান ক্রোয়াটদের মূল সমর্থন প্রথম দিকে ছিল যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে। আর হার্জেগোভিনা অঞ্চলের ক্রোয়াটরা যে এ যুদ্ধের শুরুতে তাদের প্রতিবেশী বসনিয়ান মুসলিমদের সাথে সহমত এবং সমর্থন প্রদান করেছিল সেতো আগেই বলেছি। কিন্তু সার্বদের বিরুদ্ধে ক্রোয়াট এবং মুসলিমদের সম্মিলিত যুদ্ধের এক পর্যায়ে ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগরেবে বসে প্রেসিডেন্ট তুজমান কষে ফেললেন অন্য এক অঙ্ক। তুজমান দেখলেন, এই তো সুযোগ। কি দরকার ক্রোয়াট-প্রধান হার্জেগোভিনাকে বসনিয়ার সাথে ফেডারেশন করতে দিয়ে, এর চেয়ে বসনিয়ান ক্রোয়াট গেরিলাদের বুঝিয়ে তাদেরকে সর্ব প্রকার সামরিক সহায়তা দিয়ে যদি কোনভাবে হার্জেগোভিনা থেকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিতারন করা যায় তবেই তো হার্জেগোভিনাকে ক্রোয়েশিয়ার ভেতর আত্তীকরণের ষোলকলা পূর্ণ হয়, তৈরি করা যায় এক বিশাল ক্রোয়াট-প্রধান দেশ। জাগরেব থেকে মোস্তারের ক্রোয়াট গেরিলাদের কাছে নির্দেশ গেলো, কামানের মুখ ঘোরাও, তোমাদের নতুন শত্রু এখন থেকে তোমাদের এতকালের প্রতিবেশী মুসলিমরা।

ঘুরে গেলো কামানের মুখ, তার পরের চার বছরের ইতিহাসটা কেবল বারুদ, রক্ত, মর্টার আর আহত সাধারণ মানুষের গগনবিদারী আর্তনাদ-আহাজারির ইতিহাস।

মোস্তার শহরের পূর্ব প্রান্তের বাসস্ট্যান্ডে নেমে হাঁটছি ‘মার্শাল টিটা’ সড়ক ধরে। আগেই বলেছি নেরেৎভা নদীর এই পূর্ব দিকের অঞ্চলটি ছিল মুসলিম প্রধান এবং ক্রোয়াটদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। তাই এ সড়কে হাঁটতে গেলে কেবলি থমকে যেতে হয় গুলির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত বাড়ির সামনে। টিটা সড়কে সর্বপ্রথম যে কংক্রিটের বিশাল পরিত্যাক্ত ভবনটি নজরে এলো সেটি নাকি যুদ্ধের পূর্বে বানানো হয়েছিলো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে। চুলোয় গেছে সেসব, যুদ্ধ এই এই ভবনটিকে ছিবড়ে খেয়ে আজ ফেলে রেখেছে গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হওয়া কিছু দেয়ালসহ। এলোমেলো পথ হাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম এ শহরের ফুটপাথে অবারিত হাঁটার জো নেই, বাঁধা পেয়ে মাঝে মাঝেই বাধ্য হয়ে নেমে পড়তে হয় মূল সড়কে। কারণ কিছু জীর্ণ পোড়ো বাড়ির পাশের ফুটপাথের অঞ্চলগুলো তারের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করা। পরিত্যক্ত এসব বাড়ি যে কোনও সময়ই ভেঙে পড়তে পারে, আর তাই পথচলতি কেউ যেন আহত না হয় তাই এই বাড়তি সতর্কতা। এ ধরণের বাড়িগুলো মূলত শতবর্ষী। বাড়িগুলোর কেবল বাইরের খোলসগুলোই টিকে আছে, ভেতরের রাজ্যে বাসা বেধেছে রাজ্যের আগাছা আর কিছু যাযাবর পাখি। সেকালের এই বাড়িগুলোর মেঝেগুলো খুব সম্ভবত তৈরি হতো লোহার পাতের উপর ইট-সিমেন্টের আস্তর দিয়ে। খুব সম্ভবত উপর থেকে ছাঁদ ফুটো করে মর্টারের গোলা পড়ায় মেঝেগুলো গোলার ভার আর সইতে পারেনি, হুড়মুড় করে হয়তো ভেঙে পরেছে নিচে। আর তাই বহির্ভাগের আবরণ আর ভেতরের কঙ্কালসম লোহার পাতগুলো, এ ছাড়া এই ভবনগুলোর আর কিছুই আজ অবশিষ্ট নেই।

যেহেতু অটোমানদের হাত ধরেই বসনিয়ায় ইসলামের আগমন তাই বসনিয়ার মুসলিমদের মাঝে তুর্কী প্রভাব প্রবল। তাদের ভাষা, ঐতিহ্য, খাদ্যাভ্যাস, মসজিদের স্থাপত্য- সবখানেই ছড়িয়ে আছে নানা তুর্কী উপাদান। মসজিদের মিনারের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে যেমন একই শহরে ভিন্ন স্থাপত্যের মসজিদের মিনার দেখা যায়, বসনিয়ায় কিন্তু আমার চোখে পড়লো উল্টো চিত্র। পুরো দেশে আমার চোখে যতগুলো মসজিদ চোখে পরেছে তার সবগুলোর মিনার একই তুর্কী স্থাপত্য-রীতিতে তৈরি, যে রীতিতে মিনারগুলোর অগ্রভাগকে বানানো হয় অনেকটা তুর্কী টুপির মতো করে। সময়টা রমজানের মাস। তাই হয়তোবা একটি মসজিদের সামনে লেখা “বায়রাম শেরিফ মুবারেক অলসান”। বসনিয়ার মুসলিমরা এভাবেই রমজানকে স্বাগত জানায়, আশীর্বাদ কামনা করে আসন্ন উৎসবের জন্যে।

নেরেৎভা যদিও একটি নদী, কিন্তু আদতে এটি একটি খালের চেয়ে প্রশস্ত কিছু নয়। চলার পথে অসংখ্য এবড়ো খেবড়ো পাথর কেবল বাড়িয়ে দিয়েছে তার গতি। এ নদীর উপরের এক সেতু পেড়িয়ে এবার চলে এলাম নদীর পশ্চিম প্রান্তে, আপাতত গন্তব্য দখিনের প্রস্তর সেতু।

এপারের বাড়িঘরের অবস্থাও সেই একই, একেবারেই জীর্ণ যেই বাড়িগুলো সেগুলোর দেয়ালের সাথে কাঠের তক্তা জুড়ে দেয়া হয়েছে আপাত-পতন ঠেকাবার জন্য। কি অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে এই বাড়িগুলোর সামনে দাঁড়ালে। মাত্র দু’ দশক আগে এই বাড়িগুলোর প্রতিটিতেই থাকত কতনা পরিবার, এই কড়িবর্গাগুলোর প্রতিটির সাথেই হয়তো মিশে আছে তাদের দিনযাপনের কথকতা, আর্তনাদ আর হাহাকার। কোথায় হারিয়ে গেলো এর অধিবাসীরা? কে জানে? হয়তোবা তাদের কেও শুয়ে আছে নিকটস্থ গোরস্থানে, আর কেও কেও হয়তো প্রাণ বাঁচাতে পরবাসী হয়েছে দূর কোনও দেশে।

অন্য আর যে ভবনগুলোতে আজ দেখা যায় জনমানুষের চিহ্ন, সেগুলোর একটিকেও অক্ষত অবস্থায় আমার চোখে পড়েনি। প্রতিটি দেয়াল, জানালা, সামনের বারান্দায় দগদগে ঘায়ের মতো অজস্র ভারী গুলির আঘাতের চিহ্ন। যেহেতু এই বিশ বছরেও সেই ক্ষতগুলো বুজে দেয়া হয়নি, তাই বোধ করি এর অধিবাসীরা এখনও আর্থিকভাবে এখনও তেমন স্বচ্ছল নন।

মোস্তার শহরটি মূলত পরিচিত নেরেৎভা নদীর ভাটিতে দু’কূলের মাঝে সংযোগকারী প্রস্তর সেতুর কারণে। এই সেতুটি অটোমানদের দ্বারা তৈরি প্রায় পাঁচশো বছর পূর্বে। সে যুগে যেখানে অধিকাংশ সেতুই নির্মিত হতো কাঠ দিয়ে, সেখানে এই সেতুটি তৈরি করা হয়েছিলো আশেপাশের পাহাড় থেকে জোগাড় করে আনা পাথর দিয়ে। আরেকটি বিশেষ কারণে এই সেতুটি দৃষ্টিনন্দন, আর তা হল এর বুমেরাং আকৃতির গঠন। পাঁচশো বছর ধরে শক্ত গাঁথুনির এই সেতুটি টিকে থাকলেও তাকে হার মানতে হয়েছিলো ক্রোয়াটদের গোলার কাছে বিগত যুদ্ধে। সে সময় এই সেতুটির অসংখ্য চিত্র এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ-মাধ্যমে। পশ্চিমের ক্রোয়াট-প্রধান এলাকাগুলো থেকে পালাবার জন্যে মুসলিমদের প্রধান পথ ছিল এই সেতুটি, যে কারণে এই সেতুটি হয়ে পরে ক্রোয়াট স্নাইপারদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে। উন্মত্ত ক্রোধে গলার কাঁটা হয়ে থাকা এই সেতুটিকে তারা এক পর্যায়ে গুড়িয়ে দেয় মর্টারের গোলার আঘাতে। যুদ্ধের পর অবশ্য আন্তর্জাতিক সহায়তায় আবার এই সেতুটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। তাই আজ আমি যেই সেতুটির সামনে এসে দাঁড়ালাম সেটি আর সেই অটোমানদের নির্মিত সেতুটি নয়, বরং তার স্থলে অবিকল একই স্থাপত্যে নির্মিত নতুন এক সেতু। এমনকি আগের রূপ বজায় রাখার জন্যে নাকি এই পুনর্নির্মাণের সময়েও ব্যাবহার করা হয়েছে আশেপাশের পাহাড়ের পাথর।

কোনও নতুন জায়গায় ঘুরতে গেলে আমি সাধারণত দু’একটি স্যুভেনির ছাড়া আর কিছুর দিকে হাত বাড়াইনা, কারণ ভাবি কি দরকার চলতি পথে হাতের বোঝা বাড়িয়ে। কিন্তু মোস্তারের এই প্রস্তর সেতুর দু’পাশের বাজারে এমনি সব হরেক পণ্য ঠাসা যে, আমি তো ছাই প্রবল সংযমী পর্যটকেরও সংযমের বাঁধ ভাঙতে বাধ্য। কি চাই আপনার? ঘরের টেবিলের উপর রাখবার রেশমি রুমাল নাকি চা ঢালবার সুদৃশ্য পাত্র? পরিত্যাক্ত বুলেট থেকে তৈরি কলম থেকে শুরু করে বলকানের মিঠা জলের মুক্তার মালা, এমনি আরও বহু জিনিস আপনার থলেতে ভরবার পর একটু জিরোবার যদি প্রয়োজন হয়ে পড়ে তবে চলুন বসা যাক এই বাজারের মাঝেই সামনে বেঞ্চ পেতে দেয়া কোনও এক বসনিয়ান রেস্তোরাঁয়।

বৈশ্বিকতার ঠেলায় আজকাল এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে যেকোনও দেশেই সে দেশের ঐতিহ্যগত খাবার পাওটাই একটা রীতিমতো কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ঢাকার কথাই ধরা যাক না। পিৎযা, বার্গার আর নানাবিধ চাইনিজ খাবারের ঠেলায় একজন ভিনদেশীর পক্ষে হয়তো প্রকৃত বাংলাদেশী খাবার খুঁজে পেতে রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হবে। বসনিয়ায় অন্তত এখন পর্যন্ত সে ঝামেলা নিতান্তই কম। যদিও বসনিয়ায় প্রচলিত যে খাদ্য সংস্কৃতি সেটি মূলত তুর্কী প্রভাব থেকে উদ্ভূত, তাই বসনিয়ান খাবারের সাথে তুর্কী খাবারের সাযুজ্য প্রবল।

যে রেস্তোরাঁয় এসে বসলাম সেটির মালকিনের মাথায় কাপড় দেখে বুঝলাম তিনি একজন বসনিয়ান মুসলিম। যদিও রমজানের সময়, কিন্তু তাই বলে আমাদের দেশের মতো চারদিকে কাপড়ের পর্দা টেনে চুপি চুপি খাবার ব্যাপারটি চোখে পরলনা। শুধু এই রেস্তোরাঁটিই নয়, নেরৎভা নদীর পূর্ব প্রান্তের এই মুসলিম প্রধান এলাকার কোনও রেস্তরাঁতেই আমার রমজান মাস কেন্দ্রিক কোনও বিধিনিষেধ চোখে পড়েনি। কিন্তু কতদিন তারা এই উদার সংস্কৃতি ধরে রাখতে পারবে সেটাই হল প্রশ্ন, আজ থেকে বিশ কি ত্রিশ বছর পর তারাও যদি মৌলবাদের পথে পথ চলা শুরু করে আমি অন্তত খুব বেশি অবাক হবোনা।

বসনিয়ার রসুই ঘর নিয়ে বলতে গেলে মনে হয় শুরু করা ভালো যে জিনিসটি মোটামুটি সব খাবারেরে সাথে পরিবেশন করা হয় সেই রুটি দিয়ে, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় লেপিন্যে। বসনিয়ানদের এই রুটি দেখতে অনেকটা মেক্সিকান পিটা রুটির মতো, তবে পার্থক্য এই যে এই রুটির মাঝখানটা ফাঁপা। সাধারণত এ রুটির মাঝখানের অংশে দু’ ফালি করে এই ফাঁপা অংশে মাংস পুরে পরিবেশন করা হয়। সদ্য চুলো থেকে নামিয়ে আনা গরম সেঁকা এই লেপিন্যে রুটি মুখে দিলে মনে হয় অন্য কিছু নয় কেবল এই রুটি দিয়েই পেট ভরিয়ে নেয়া যায়। মাংশের দিক দিয়ে বসনিয়ানদের প্রথম পছন্দ গোমাংস, এর পর ভেড়ার মাংশ। আর তাই বসনিয়ান খাবারের পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই এই দুটি মাংশ দিয়ে তৈরি। বসনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত খাবার চেভাপির কথাই ধরা যাক না কেন, এই চেভাপি তৈরি হয় গোমাংস আর ভেড়ার মাংশের মিশ্রণকে মণ্ড তৈরি করে সে মণ্ডের সাথে পাপড়িকা, দৈ, ডিম, রসুন আর মাখন যোগ করে জলপাই তেলে কড়াই ভাঁজা করার মধ্য দিয়ে। এর পর এই মণ্ডকে ছোট ছোট টুকরো করে রুটির ভাজে পুরে পরিবেশন করা হয়। বলকান অঞ্চলের আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হল বুরেক। এ খাবার দেখতে অনেকটা পেঁচানো গোল পেটিসের মতো। বলকানের অঞ্চলভেদে এই বুরেকের ভেতরকার মালমসলাও ভিন্ন হয়। সাধারণত বুরেকের ময়দার আস্তরণের নিচে পুরে দেয়া হয় পনির, আলু, পালংশাক কিংবা গোমাংসের মিশ্রণ। ক্রোয়েশিয়ায় আর সার্বিয়ায় যেমন সকল ধরণের বুরেকের সম-প্রাধান্য চোখে পড়েছে, বসনিয়ায় এসে মনে হল এখানে শুধুমাত্র গোমাংসের বুরেকই একমাত্র জনপ্রিয়। রেস্তোরাঁর খাবারের ম্যেনুতে আরও নাম না জানা বেশ কিছু খাবারের তালিকার উপর নজর বুলাবার পর দুপুরের খাবারের জন্যে নির্বাচন করলাম চিকেন ফিলেতি নামের অন্য এক পদ, যেটি পরিবেশন করা হয় মিষ্টি পেঁয়াজের কুচি, শসা আর টমাটোর সাথে জলপাই তেলে ভাঁজা কুক্কুটের মাংশ সহযোগে। বেশ ভর পেট খাবার খেয়ে ঢেকুর তুলে উঠবার সময় মনে হল এ বেলা একটু চা না হলে হয়তো পথেই ভাতঘুমে এলিয়ে পড়তে পাড়ি। মজার ব্যাপার হল এ দেশে কিন্তু চা কে বলা হয় “চাই”, আর এই চাই পরিবেশন করা হয় লম্বাটে হাতলছাড়া এক ছোট কাঁচের পেয়ালায়। হয়তোবা চায়ের প্রকৃত স্বাদকে অবিকৃত রাখার জন্যে এ চায়ের সাথে আর দুধ যোগ করা হয়না, আর মিষ্টির জন্যে সাথেই দেয়া হয় এক টুকরো ঘনক আকৃতির চিনি। একটু সন্দেহ ছিল চিনির ওই পরিমাণ নিয়ে, কিন্তু মেশানোর পর বুঝলাম এই চায়ের পরিমাণের সাথে ওই চিনির ঘনকের নিখুঁত এক সম্পর্ক আছে। কারণ মিষ্টির মাত্রাটি এক্কেবারে ঠিক, যেন চায়ের পরিমাণের কথাটা মাথায় রেখেই বানানো হয়েছে চিনির ওই ডেলা।

ষোলশ শতাব্দীতে অটোমান শাসনামলে নির্মিত মেহমেদ পাশা মসজিদটি এই বাজারেরই এক শেষ প্রান্তে নেরেৎভা নদীর ঠিক গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এই মসজিদটিই বলতে গেলে প্রস্তর সেতুর সব চেয়ে কাছের মসজিদ। এই সাদামাটা মসজিদটি পুরনো হলেও পরিত্যাক্ত নয়, মসজিদের ভেতরের মেঝেটি ঢাকা নানা রকমের বাহারি গালিচায়। এটিই আমার দেখা প্রথম মসজিদ যেখানে দেখলাম নারী-পুরুষ সকলের জন্যেই অবারিত দ্বার। মানে বোঝাতে চাইলাম নারীপুরুষ সকল ধরণের পর্যটকই ভেতরে ঢোকার অনুমতি পায়, তবে প্রার্থনার নিমিত্তে যাওয়া নারীপুরুষ একত্রে নামাজ পড়তে পারে কিনা তা বলতে পারবনা। পর্যটকদের অবশ্য ভেতরে ঢোকার জন্যে কিছু দক্ষিণা দিতে হয়। অনেকে সেই দিয়ে ভেতরে ঢোকেন শুধুমাত্র এই মসজিদের অন্তর্ভাগ দেখার জন্যে নয়, বরং এর সরু মিনারের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে চুড়োয় উঠে নেরাৎভার বুকে রামধনু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রস্তর সেতুর একখানা জম্পেশ ছবি ফ্রেমবন্দী করার জন্যে।

এই বাজার এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে একটা কথা মাথায় আসছিলো, আর তা হল যুদ্ধ শেষ হলেও কি থেমে গেছে দু’ জাতির পারস্পরিক অবিশ্বাস? নাকি অতীতের তিক্ততা তারা এখনও পুষে রেখেছে মনের ভেতর? কয়েক জনের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু খুব একটা সুবিধে করতে পারলাম না। খেয়াল করলাম প্রায় সবাই এই ব্যাপারে কথা বলতে একটু ইতঃস্তত বোধ করে, আড়চোখে তাকায় চারপাশে, তারপর তাদের উত্তরটি হয় অনেকটা এমন, “ যা হয়েছে অতীতে সে নিয়ে আর কথা না বাড়ানই ভালো, তা তোমার কথা বল, কতদিন থাকছ মোস্তারে?”

না মোস্তারে আর থাকা হচ্ছেনা, কেননা আজই বিকেলের ট্রেনে আমাকে যেতে হবে সারায়েভতে। ট্রেন ষ্টেশনে ফেরার সময় ফিরছিলাম সেই মার্শাল টিটা সড়কের সমান্তরালে থাকা আরেকটি সড়ক ‘ব্রাচে ফেহিচা’ ধরে। এ সড়ক ধরে চলতে গিয়ে ডান পাশের এক গোরস্থানের সামনে এসে এক অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলাম। হলুদ, লাল আর সাদা গোলাপে ছেয়ে আছে এ সমাধিক্ষেত্রের এপিটাফের বেদিগুলো। গোলাপের অজস্র পাপড়ির ফাঁকে ফাঁকে দৃশ্যমান হয় কিছু জন্ম আর মৃত্যু সাল। জন্ম সালগুলো ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন বছরে, এই যেমন, “১৯৬৭”, “১৯৭০”, “১৯৫৬” কিংবা “১৯৪৩”। কিন্তু কি আশ্চর্য সব এপিটাফেই মৃত্যু সালগুলো এসে ঠেকেছে একটি মাত্র সনে, আর আর সেই সনটি হল “১৯৯৩”। বুঝলাম এটি কোনও সাধারণ গোরস্থান নয়, খুব সম্ভবত ১৯৯৩ এর যুদ্ধে প্রাণ হারানো শহীদদের সমাধিস্থল এটি।

ট্রেন ষ্টেশনে গিয়ে জানলাম পরের ট্রেন ছাড়তে তখনও প্রায় আড়াই ঘণ্টা বাকি যেটি সারায়েভো গিয়ে পৌঁছাবে রাত দশটা নাগাদ, আর অদূরের বাসস্ট্যান্ডে পরের বাসটি ছেড়ে যাবে মাত্র ত্রিশ মিনিট পর। তাই ভাবলাম এতো রাত করে সারায়েভো পৌঁছানোর চেয়ে এই তো ভালো যদি দেড় ঘণ্টা আগেই পৌছাতে পারি। দিনের আলো থাকতে থাকতে এ বেলা রওনা দিলে পথের রূপটিও বেশ দেখা যাবে। তাই আর দ্বিধা না করে বাসের টিকেটিই কিনে ফেললাম। তবে ওদিকে আবার সারায়েভোতে যে হোটেলে উঠবো তার হোটেল মালিককে আগেই বলা আছে আমাকে ট্রেন ষ্টেশন থেকে তুলে নিয়ে যেতে। এখানে একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেলাম সারায়েভোতে নাকি ট্রেন আর বাস ষ্টেশন ওই একই স্থানে। তবে তো আর কোনও সমস্যাই রইলনা। মনে মনে ভাবলাম সারায়েভোতে বাস স্ট্যান্ডে নেমে পাশের ট্রেন ষ্টেশনে হেঁটে গিয়ে হোটেলের লোকের জন্যে অপেক্ষা করব। তবে যতটা ‘জলবৎ তরলং’ ভেবেছিলাম, আমার এই অপেক্ষার পালাটা ততটা সরল ছিলনা। সে গল্প না হয় হবে অন্য এক দিন।


Comments

তাহসিন রেজা's picture

চমৎকার লেখা, এমন ভ্রমণ গল্পই তো চাই। কেমন আরামে পড়ে গেলুম হাসি

আপনার পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

জীবনযুদ্ধ's picture

ধন্যবাদ আপনার এই সুন্দর মন্তব্যের জন্যে হাসি

জীবনযুদ্ধ's picture

সপ্তাহ খানেকের ভেতরেই লিখে ফেলবো আশা করছি, আপনাকে ধন্যবাদ

অতিথি লেখক's picture

অসাধারণ। খুব ভাল লাগলো। পরের পর্ব কবে পাচ্ছি?

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নজমুল আলবাব's picture

বাহ

পরের পর্বের অপেক্ষায়

জীবনযুদ্ধ's picture

ধন্যবাদ নজমুল ভাই

অতিথি লেখক's picture

সারায়েভোর অবরোধ ছিল আধুনিক কালে কোন নগরের সবথেকে বেশি সময় ধরে অবরোধ।

একাকী মানব

জীবনযুদ্ধ's picture

ঠিক, সেই নিয়ে কিছু গল্প-কথা পরের পর্বে আসছে

অতিথি লেখক's picture

ছবি গুলো বড় সুন্দর। একটা লেপিন্যের ছবি পেলে দারুন লাগত। পরের পর্ব আসুক তাড়াতাড়ি।
হাসি
----------------------------------------
ইচ্ছে মত লিখি
http://icchemotolikhi.blogspot.in/

জীবনযুদ্ধ's picture

ধন্যবাদ আপনাকে

জীবনযুদ্ধ's picture

পান্ডবদা, টিটো এবং যুগোস্লাভিয়া নিয়ে তাদের মূল্যায়ন কি সেই প্রশ্নটা আমার মাথায় প্রথম থেকেই ছিল, সারায়েভো গিয়ে এ নিয়ে কযেক জনের সাথে কথা বলেছি, সেটা মন্তব্যের ঘরে না লিখে পরের পর্বে লিখি?

৭৪ এর সংবিধানের ব্যাপারে আপনি ঠিকই বলেছেন, এ সংবিধানে মূলত আঞ্চলিক সরকারগুলোকে আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়, বাড়ানো হয় তাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

আপনার ভ্রমণকাহিনী সবসময়েই আমার পছন্দ। বসনিয়ার ওপর বাংলায় লেখা আগে পড়িনি। বসনিয়ানরা ইউগোশ্লাভিয়া পর্বকে কীভাবে দেখে? জোসিপ তিতো'র ব্যাপারে তাদের মূল্যায়ণ কী? এসব কি কিছু শুনতে পেয়েছিলেন? পরের পর্বের অপেক্ষায়।

পুনশ্চঃ ১৯৪৬ সালে সোসালিস্ট ফেডারেল রিপাবলিক গড়ে তোলার সময়ই স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, মন্টেনেগ্রো আর মেসিডোনিয়াকে পূর্ণাঙ্গ সোসালিস্ট রিপাবলিক রূপে আর কসভো আর ভয়ভোদিনাকে স্বায়ত্ব্বশাসিত প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে কসভো আর ভয়ভোদিনার মর্যাদা বাকি রিপাবলিকগুলোর পর্যায়ে তোলা হয়। ইউগোশ্লাভিয়া ভাঙার পেছনে আধিপত্য বিস্তারে সার্ব-ক্রোয়াটদের মধ্যকার অনন্ত দ্বন্দ্ব, বলকান উপদ্বীপের জাতিপ্রকৃতি (Balkanization শব্দটি তো আর এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি), সমাজতন্ত্রের নামে সার্ব কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান এমন আরো অনেক কিছু আছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শাব্দিক's picture

এক ইউরোপিয়ানকে আপ্যায়ন করতে বাড়িতে দুধ চা দেয়া হলে সে খুব অবাক হয়ে বলেছিল "চাই" এ তোমরা দুধ মেশাও কি করে? এর স্বাদ তার কাছে দারুন মনে হয়েছিল। ওই দিকের লোকেরা চা তে দুধ মেশানোর ব্যপারটা তেমন একটা জানেই না।

চমৎকার সব ছবির সাথে ইতিহাস জানলাম অনেকখানি।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

জীবনযুদ্ধ's picture

ধন্যবাদ, হ্যা, চায়ে দুধ মেশানো হলে অনেক সময় এর মূল স্বাদটা বোঝা যায় না

Rajibul Hasan's picture

খুব ভালো লাগলো।।।।

রোমেল চৌধুরী's picture

ভ্রমণকাহিনী হতে হলে এমনই হতে হয়। যেখানে ঘটনার বর্ণনার চাইতে লেখকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণলব্ধ অভিমত থাকে বেশি। খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বেশ ক'টি কন্টিনজেন্ট অবরোধ ও আপদকালীন সময়ে দীর্ঘক্রমে সেখানে জাতিসংঘের ব্যানারে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। তাঁদের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকে বসনিয়ার ক্ষরিত হৃদয়ের স্পন্দন জানতে পারা যায়।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

জীবনযুদ্ধ's picture

ধন্যবাদ সময় নিয়ে লেখাটি পড়বার জন্যে। বসনিয়া নিয়ে সেনাবাহিনীর কারও কোনোও লেখার রেফারেন্স আপনার কাছে আছে কি? থাকলে পোস্ট করতে পারেন, পড়ে দেখতাম।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.