রাশিয়ার দিনলিপি: সকালের চাঁদ

নীলকান্ত's picture
Submitted by nilkanto on Sat, 20/12/2014 - 11:50am
Categories:

আগের দিন প্লেন থেকে নেমেই একটা ছবি তুলে ব্লগ পোস্ট করেছিলাম, লেখাটা তাই হয়ে গিয়েছিল ছোট। আজকেরটা কতটুকু হবে বলতে পারছি না, রাশিয়ান সময় সকাল নয়টা বাজছে প্রায়।

ছুটি দীর্ঘদিনের হলেও কাজ সাথে করে কিছু সবসময় আনা হয়। এর মধ্যে ল্যাপটপ নিয়ে আসা হয়নি, কাজ যাতে কম করা হয়। পেনড্রাইভে সব ফাইল অবশ্য নিয়ে রেখেছিলাম, যা বর্তমানে ল্যাপটপের সাথে দুই ফুট বাই এক ফুট এক ড্রয়ারে অবস্থান করছে।

প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশন শেষ করে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। বান্ধবীর আসার কথা এক ঘন্টা পর, জুরিখে থাকতেই টেক্সট করেছিল দেরি হবে।

এবার উঠছি আগেরবার এসে পরিচয় হওয়া নাতালিয়ার বাসায়, উঠতি অর্থনীতিবিদ, বেশ নাম কামিয়েছে অল্প সময়ে, বয়স ২৬ এর একটু বেশি।

সেন্ট পিটার্সবার্গ মস্কো থেকে অনেক ভিন্ন, মস্কোতে ইংরেজির বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। সব রুশ ভাষায়, অন্যদিকে পিটার্সবার্গ কসমোপলিটন। বিমানবন্দর, ট্রেন স্টেশন সর্বত্রই ইংরেজি সাইনবোর্ড, রুশ ভাষার পাশে।

নাতালিয়ার আসতে একটু দেরিই হলো। মাঝখানে বসে বসে রাশিয়ান ইংরেজি পত্রিকা পড়তে লাগলাম, পুতিনের ভাষণ নিয়ে বিস্তর আলোচনা আর রুবেলের পতন, এই আলোচ্য বিষয়।

আগেই বলেছি, রাশিয়ানরা পরিচিত মানুষ দেখলে এক গাল হাসি দেয়, মেকি কিছুই থাকে না তাতে। আর অপরিচিত হলে, দরকার না পড়োলে ঘাটায় না।

আমার মধ্যে অবশ্য একটু মেকি ভাব এসে পড়েছে, মার্কিন মুল্লুকে থাকতে থাকতে। আমার ল্যাবের সহপাঠীদের একজন সারাদিন "হাউয়ারিউ' বলে পাশ দিয়ে চলে যায়, উত্তরের অপেক্ষা না করে। আমিও খেয়াল করে দেখলাম ইদানীং তাই করি, আমেরিকানদের সাথে।

যাইহোক। আসলে, আমার সমস্যা অন্য, আমার কোন লেখাই তেমন গোছানো হয় না। কারণ মাথার মধ্যে এক বিষয় থেকে অন্য বিষয় চলতে থাকে।

নাতালিয়ার সাথে তার প্রেমিক স্টাস, স্টাসের সাথে আগেরবার পরিচয় হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেম, স্টাস বর্তমানে চাকরি বাকরি ছেড়ে, বাসায় বসে থাকে। দরকার পড়লে রেস্তোরার বেয়ারার কাজ করে।

রাস্তায় বের হবার পর দেখি ভিজা সড়ক, সূর্য নাই হবার পথে। গাড়িগুলো দেখে মনে হয় দীর্ঘদিন ধোঁয়া হয় না (বরফ গলে পানি পরে ফ্রস্ট হয়ে গেছে)।

আগের দু'বার এত ঠাণ্ডা ছিল না, এবার সত্যিকার অর্থেই শীতকালে আসা, পরিকল্পনাতে সাইবেরিয়াও আছে। নাতালিয়ার গাড়িতে আমরা তিনজন। ড্রাইভার স্টাস। পুরোপুরি রাশিয়ান ভঙ্গিমায় গাড়ি চালায়, বিন্দুমাত্র সতর্কতা ছাড়া, সিগন্যালের দিকে না তাকিয়েই বলা চলে।

কে বলবে রাশিয়ায় অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। রাস্তার দু'পাশে ল্যাম্পপোস্ট আলোকসজ্জায় সজ্জিত। দোকানগুলো বড়দিনের সাজে সজ্জিত। গাছগুলো পুরোপুরি পাতাহীন।

নাতালিয়া জিজ্ঞেস করলো, সরাসরি বাসায় নাকি অন্য কোথাও যাবো। বললাম তেমন একটা ক্লান্ত লাগছে না, বোনা কাপোনাতে যাবো। নাতালিয়া হেসে ওঠে। এই এক জায়গার খাবারের আমি বিশাল ভক্ত হয়ে গেছি। তেমন আহামরি কিছু না তবু আমার কাছে ভাল লাগে।

রাশিয়ান চা'র ভক্ত আমি, দিন শেষে ঘুমাতে যাবার আগে এরা চা খেতে পছন্দ করে। ডিনার শেষে একটু মিষ্টি সাথে চা। এই রাশিয়াতে এসেই নানলিনের সাথে পরিচয় হয় চা খেতে গিয়ে। জাতিতে চৈনিক, নানলিন সেবার ট্রান্স-সাইবেরিয়ার পথে মঙ্গোলিয়া হয়ে দেশে ফেরত গিয়েছিল। ওর বাসায় একদিন শুদ্ধ চীনা পদ্ধতিতে চা খেয়েছিলাম।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শুনলাম নাতালিয়ার দেরি হবার কথা। ব্যাংকগুলো নাকি দেউলিয়া হবার পথে। নগদ অর্থের সংকট কয়েকদিন ধরে। সবাই ডলারের বিপরীতে রুবেলের পতনের কথা বলছে। ও বললো ইউরোর কথা। ইউরোপের সাথে ব্যবসা বেশি বিধায়, ইউরো বেশি ঝামেলা করছে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোতে ইউরো নেই বললেই চলে। ১১০ রুবেল দিয়েও নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। জিনিসপত্রের দাম প্রায় ৩০ ভাগ বেড়েছে। রেস্তোরার অবস্থা দেখে অবশ্য এটা বোঝা যাচ্ছে। মেনুতে অনেক কিছুরই দাম মুছে বলা হয়েছে ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করতে। প্রতিদিন এত বেশি পরিমাণে দাম ওঠানামা করছে।

স্টাস এসব আলোচনায় বোঝা গেল নির্লিপ্ত। নাতালিয়া জানালো, ও এরকম শাকাহারী জীবনযাপন করছে। জীবন ও জগতের প্রতি মোহমুক্ত হবার চেষ্টা। আমি বললাম, নাতালিয়া টাকা কামানো বন্ধ করে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। নাতালিয়া বললো, না তা হবে না। আমারটা শেষ হলেও ওর বাবারটা শেষ হবে না।

নাতালিয়ার বাসায় পৌঁছালাম প্রায় ৯ টায়, বাসা বলা ঠিক হবে না। আমাদের দেশের বসুন্ধরা সিটির সমান আটতলা এক ভবন। মোট ৮৪ টা ফ্ল্যাট, এর মধ্যে ৪ টা নাতালিয়ার পরিবারের, এর একটায় আমি থাকবো। চক্ষু চরাখগাছ অবস্থা।

রাশিয়ায় প্রবেশের পর প্রত্যেককে রেজিস্ট্রেশন করতে হয় আমন্ত্রণকারী সংগঠনের বা ব্যক্তির মাধ্যমে ( ভিসা পেতেও আমন্ত্রণপত্র লাগে)। গত দু'বার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আসার কারণে আমলাতান্ত্রিক ঝামেলা ছিল কম। এবার পুরোটাই আমার। নাতালিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম রেজিস্ট্রেশন করার বিষয়ে কোন ধারণা আছে কিনা, হেসে খালি বললো পাসপোর্টটা দিতে।

ক্লান্ত ছিলাম বিধায় গোসল করে এসে শোবার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঊঠতে উঠতে আটটা বেজে গেল, উঠে দেখি বাইরে এই অবস্থা।

ছবি: 
16/04/2010 - 3:19অপরাহ্ন

Comments

অনার্য সঙ্গীত's picture

এইবারও ভগিজগি দিয়া ক্রাসিভার ছবি কাটায় গেলা মিয়া! ঠিক্না, এসব ঠিক্না!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

ক্রাসিভা কী?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনার্য সঙ্গীত's picture

"সুন্দরী", পাণ্ডব'দা।
"রুস্কায়া ক্রাসিভা" হচ্ছে রাশান সুন্দরী দেঁতো হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

এক লহমা's picture

দিব্যি এগোচ্ছিল লেখাটা! কি যে এক হ্যাঁচকা মেরে থামিয়ে দিলেন! জলদি জলদি পরের পর্ব দ্যান। আর অনার্যর কথা কিন্তু পুরাই ন্যায্য - একটু খিয়াল রাইখেন। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.