রাজকুমারী চাঁদনিবালার ছবি - প্রথম পর্ব

সত্যপীর's picture
Submitted by mir178 on Sun, 23/11/2014 - 9:14am
Categories:

বারো বছর বয়েসী রাজা জগৎ সিং আমার দিকে তাকিয়ে বড়দের মত গম্ভীর গলায় বললেন, নাম কবুতর ফারুক ঠিক আছে। কোন অসুবিধা নাই। তবে নামটা তোর তেলাপোকা ফারুক হলে আজই তোর গর্দান নিতাম।

আমি মাথা চুল্কে হেঁ হেঁ করে হাসলাম একটু। অপমানিত হব কিনা বুঝতে পারছি না। এরকম রিনরিনে কন্ঠে বাচ্চা পুলাপানের গলায় তুই তুকারি শুনলে বিরক্ত লাগে বটে, তবে রাজা তো রাজাই। বয়েসে কি আসে যায়। তুই তুকারি করতেই পারেন। তেলাপোকা আর গর্দান বিষয়ক ঘটনা অবশ্য ঠিক ধরতে পারলাম না।

রাজার পাশে দাঁড়ানো মন্ত্রী ঝুঁকে রাজার কানে কানে কিছু বললেন। তাই শুনে বারো বছর বয়েসী রাজা জগৎ সিং ভারি খুশী হয়ে হাততালি দিলেন জোরে দুইবার। সঙ্গে সঙ্গে শশব্যস্ত হয়ে বাইরে দুই পেয়াদা সরে দাঁড়াল আর হাতে একটা পিঁড়ির মত কি একটা হাতে ঢুকল একজন। পিঁড়ির উপর কিছু একটা নড়ছে মনে হল। দরবারে দাঁড়িয়ে থাকা মান্যগণ্য সকলে ঝুঁকে দেখতে লাগলেন আর ফিসফিস করে একে অপরকে কীসব বললেন কেউ কেউ। আমি দেখতে যাচ্ছিলাম ভালো করে, এমন সময় পাশে দাঁড়ানো এক পাইক ধাক্কা মেরে আমাকে এক কোণায় সরিয়ে দিল।

ঘটনা কী?

পিঁড়িওলা সাবধানে পিঁড়িটা নামিয়ে রেখে তার পাশে কলাপাতা দিয়ে কেমন একটা ঘেরের ব্যবস্থা করল, আর আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখি পিঁড়ির উপর একটা তেলাপোকা! তার লেজ বা পেছনের পায়ে জরির ফিতে দিয়ে বাঁধা পিঁড়ির সাথে। লাল রঙের জরি।

আমি কিছুই বুঝলাম না। পিঁড়ির মধ্যে তেলাপোকা বাঁধা কিজন্য? তেলাপোকার লড়াই হবে নাকি মোরগ লড়াইয়ের মত? আর রাজা যে বলছিলেন আমার নাম তেলাপোকা ফারুক হলে গর্দান যাবে তারই বা অর্থ কী? এদিকে আবার লাল জরিতে বাঁধা তেলাপোকা। মহা মুস্কিল হল। রাজার সাথে আমার একান্তে কথা বলা জরুরী, তেলাপোকার জন্যে আপাতত তা হবে না মনে হচ্ছে। ভেজাল।

পাশ থেকে একজন ফুঁ দিয়ে নহবতের মত কি একটা বাজাল, তাতে সকলে চুপ মেরে গেল দরবারে। রাজা সিংহাসনের হাতলে হাত ঠেকিয়ে বসলেন। বুড়া মন্ত্রী পিঁড়ির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলতে থাকলেনঃ

হে তেলাপোকা রাজ্যের প্রধান। বিশ দিন আগে তোমাকে এই রাজভবনের দরবারে তলব করে আনা হয় এবং হুকুম করা হয় যেন তুমি তোমার রাজ্যের সকল তেলাপোকাকে অবিলম্বে রাজা জগৎ সিং এর দেশ ছেড়ে যেতে নির্দেশ দাও। আজ তিরিশ দিন হয় রাজা জগৎ সিং এর দেশে সকল তেলাপোকা সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত। কিন্তু মহৎ শাসক জগৎপ্রতাপ সিং এর মন কোমল। তিনি সকল তেলাপোকা চিরতরে নির্মূল করবার পূর্বে বিশ দিন বেঁধে দেন যেন তোমার অধীন সকল তেলাপোকা অন্যত্র সরে যাবার সময় পায়।

হে তেলাপোকা রাজ্যের প্রধান। আজ একুশতম দিন এবং ভোরবেলা লক্ষ্মণতোরণের বাইরে বারোটি তেলাপোকা ধরা পড়েছে। তাদের একজনের বর্ণ ধবল। তাদের সকলকে রাজার আদেশে তৎক্ষণাৎ আটক করে তলোয়ার দ্বারা হত্যা করা হয় এবং সকলের দ্বিখন্ডিত দেহ তোরণের নিকটে বর্তমানে ঝুলন্ত। সুতরাং রাজার এই সিদ্ধান্ত যে, তেলাপোকারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশ ছেড়ে যায়নি, অথবা তারা তোমার শাসন মানে না।

তেলাপোকা রাজ্যের প্রধান, এই বিষয়ে তোমার কোন বক্তব্য আছে?

এই বলে মন্ত্রীমশাই থামলেন, আর দরবারভর্তি লোক চুপ করে তাকিয়ে রইল পিঁড়ির দিকে। যেন সত্যই সকলে আশা করছে লাল জরিতে বাঁধা তেলাপোকা রাজ্যের প্রধান এখন কিছু একটা বলে উঠবে। ভালো পাগলের পাল্লায় পড়া গেল, আমি ভাবলাম। বালক রাজার মাথা নষ্ট এই কথা আমি শুনে এসেছিলাম বটে, কিন্তু ঠিক তেলাপোকার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণাকারী উন্মাদ বালক এতটা আমি ভাবিনাই। যাক আমার কী, পাগলছাগল রাজা হলে আমার বরং সুবিধেই। ছবি আদায় করে দ্রুত সটকে পড়া যাবে।

দীর্ঘ নীরবতার পরে মন্ত্রী বললেন, তেলাপোকা রাজ্যের প্রধান। তোমার নীরবতায় এ ই প্রতীয়মান হয় যে, রাজা জগৎ সিং এর হুকুম তুমি মানো না। তুমি বিদ্রোহী। বিদ্রোহী!

দরবারের সকলে জোরে চেঁচিয়ে উঠল, বিদ্রোহী! বিদ্রোহী। কতল কর। কল্লা নামিয়ে দাও। শেষ করে দাও।

উত্তেজনায় রাজা জগৎ সিং উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাত তুললেন, আর অমনি পাশে দাঁড়ানো পাইক খড়গ তুলে দিল পিঁড়ি বরাবর এক কোপ। তেলাপোকা রাজ্যের প্রধান বেচারা গেল ফট করে মরে।

এই দেখে রাজা খুশীতে হাততালি দিয়ে উঠলেন, আর দরবারের সকলে হই হই করে উঠল আনন্দে। জয় মহারাজের জয়। তেলাপোকার বংশ হউক ধ্বংস।

মন্ত্রী পাশ থেকে আবার ঘোষণা দিলেন, আজ থেকে যে যেখানে তেলাপোকা পাবে নির্বিচারে হত্যা করবে। রাজার পাইক পেয়াদা সিপাই সান্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ প্রজা সকলকে তেলাপোকা রেহাই দিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হল। মহারাজা জগৎপ্রতাপ সিং এর দেশে তেলাপোকার ঠাঁই নাই। নাই ঠাঁই নাই।

সকলে হৈ হৈ করে সায় দিল। নাই ঠাঁই নাই। এদিকে বিদ্রোহী তেলাপোকার পিঁড়ি নিয়ে দুই পেয়াদা অন্যদিকে চলে গেল।

রাজা বললেন, খিদে পেয়েছে!

পিছনে দুইটি কচি দাসী কোথায় লুকিয়ে ছিল, এই কথা শোনা মাত্র তারা নাচতে নাচতে রেকাবী হাতে হাজির হল। তাদের পিছু পিছু পানি বা অন্য পানীয়ের পাত্র হাতে দাস। এক দাসীর রেকাবীতে নানান মিষ্টান্ন, আরেক রেকাবীতে একটা বাটি। সেই বাটি থেকে ভেসে আসা ঘিয়ের সুবাসে আমার ব্যাপক খিদে লেগে গেল, অতি চমৎকার সুবাস বটে। বাটিতে লাল মাংসের তরকারি, পাশে আবার রুটি। এই দাসীরা কোন চিপায় লুকিয়েছিল ঘটনা বুঝলাম না, এতক্ষন তো ঘিয়ের কোন গন্ধ পেলাম না!

রাজা রুটি বাদ দিয়ে সোজা বাটিতে হাত চালান করে দিলেন। মুখে এক টুকরা মাংস চালান করে চিবাতে চিবাতে আমার দিকে চেয়ে বললেন, এই কবুতর এদিকে আয়।

আমি সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম। রাজা বললেন, কি বলবি বল। সময় কম, আমি ধনুক খেলব।

আমি খুবই গলে গিয়ে বললাম, ইয়ে মহারাজ তেমন কোন ঘটনাই নয় আসলে। আমি আসছি ফতেপুর থেকে, সেথায় থাকেন বিখ্যাত চিত্রকর নূরে সিদ্দিক। দিল্লীর দরবারী চিত্রকর রুকনুদ্দিনের সাক্ষাৎ শিষ্য! সে বলল ওহে কবুতর ফারুক, রাজা জগৎপ্রতাপ সিং এর খুবই নাম শুনেছি। তার পিতা রুদ্রপ্রতাপ সিং ছিলেন এক বিরাট বাঘ! একবার তো একহাতে হাতি আটকে দিয়েছিলেন তিনি, এতই তার হিম্মৎ!

রাজা শুনে তৃপ্ত স্বরে বললেন, কথা সত্য।

কিন্তু মহারাজ, নূরে সিদ্দিকের ঠ্যাং ভাঙা। সে এক কাহিনী। একদিন কেল্লায় ঘোড়ার পিঠে করে ঢোকার সময় সামনে পড়ে এক কাঁকড়াবিছা। তাইনা দেখে ঘোড়া দিল ডাইনে দৌড় আর ঝাঁকুনিতে নূরে সিদ্দিক গেল ঢাল বেয়ে পড়ে। সেই থেকে নূরে সিদ্দিক আর হাঁটতে পারেনা, বেঁচে আছে এ ই বেশী! সে তার একটা ছবি আপনাকে উপহার দিতে চায়, মহারাজা রুদ্রপ্রতাপ সিং এর ছবি। আমি নিয়ে এসেছি, এই নিন!

বলে আমি দুই হাতে আঁকা ছবিটা তুলে ধরলাম। পাশে থাকা এক উজির এসে নিয়ে খুলে দেখল ছবিটা, তারপর রাজাকে দিল। শিকারের ছবি। দুই পাশে দুচারটা হরিণ খামোকা মরে পড়ে আছে, তার পাশে একান্ত বাধ্যভাবে শোয়া একটি চিতাবাঘ। মাঝখানে মোটা গোঁফওলা দুর্দান্ত বলশালী এক ব্যক্তি হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে, অন্যহাতে লম্বা খাণ্ডা তলোয়ার। সামনে থমকে দাঁড়িয়ে আছে এক ছাই রঙা হাতি, কেমন জবুথবু চেহারা। পিছনে লাল রঙের কাজ করা তাঁবু।

ছবি দেখে রাজা জগৎ সিং ভারি খুশী হয়ে বললেন, বাহ। চমৎকার। খুবই চমৎকার। কিন্তু এখন আমি ধনুক খেলব, তুই যা। এই কে আছিস কবুতর ফারুককে অতিথিশালায় নিয়ে যা। আমি ফিরে এসে কাল আবার দেখা করব তোর সাথে।

আমি দুই হাত জোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে আবারও ব্যাপক গলে গিয়েছি এরকম একটা মুখ করলাম।

…………………………………………………………………

বিকেল।

ছুরি দিয়ে এক টুকরা আম কেটে মুখে দিয়ে সেলিম বলল, আম চুকা!

বাইরে খুব বাতাস। আমাদের অতিথিশালার পাশেই ছোট পুকুর, তার ওপাশে কয়টা বড় গাছ। হাওয়ায় খুব নড়ছে। সেইটা দেখতে দেখতে আমি উদাস গলায় বললাম, লবণ দিয়া খা।

কাঁচা আম না তো, লবণ দিয়া খামু ক্যান?

আমি অল্প শ্বাস ফেলে বললাম, তো চিনি দিয়া খা।

সেলিমকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, চিনি দিয়া খাইলে চুকা লাগব না?

আমি উত্তর না দিয়ে দেয়ালে লোহায় ঝুলানো আমার কুর্তার ভিতর থেকে একটা বড় খাম বের করলাম। দিনের আলো পড়ে আসবে একটু পরেই, মিসকিন শা’র ছবিগুলো আরেকবার ভালো করে দেখা যাক। আজ রাতে জিনিসটা খুঁজে পাব বলে মনে হয়না বটে, তবে আসলাম মহাজনের মাথায় দুইটা লাঠির বাড়ি পড়লে সে সাথে সাথেই ছবিটা বের করে দিতে পারে। হয়তো সে তোশকের তলেই নিয়ে ঘুমায় ছবিটা। সম্ভাবনা কম অবশ্য। যাক প্রস্তুত হয়ে থাকা ভালো।

সেলিম ঘেঁষে এল কাছে। বলল, এতো ছবি? আপনে আঁকছেন?

আমি হাসলাম একটু, নাহ। আমি আঁকি নাই। এগুলান রাজা জয়চান্দের দরবারের মিসকিন শা এর আঁকা ছবি।

রাজা জয়চান্দ কে?

আমার চোয়ালটা একটু শক্ত হয়ে গেল। ছোট করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে আমি বললাম, আছিল এক হারামজাদা।

একটু অবাক হয়ে সেলিম আমার দিকে তাকাল গালি শুনে, কিন্তু কিছু বলল না। সে মন দিয়ে ছবিগুলা দেখতে থাকল। একটা ছবি দেখিয়ে বলল, আল্লা দেখেন দুইটা পুলায় কুস্তি করে, আর এই ব্যাটায় তসবি জপে। কি আজব ছবি!

আমি ছবিটা তুলে নিলাম। রাজা চোগান সিং আমাকে ছোটবেলায় কখনো কখনো ছবি দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতেন উনার মন ভালো থাকলে। আমার মনে আছে এই ছবির একটা নকল উনার কাছে ছিল। উনি আমারে এই ছবির ঘটনা বুঝিয়ে বলেছিলেন।

এই দুই কুস্তিগীর পুলার উপরেরটা বাদশা আকবর, আমি বললাম, বাদশা আকবররে চিনস?

চোখ গোল গোল করে সেলিম বলল, সত্য? বাদশা আকবর এইটা? বাদশায় কুস্তি করে ক্যান, একটা থাপ্পর দিলেই পারে!

আকবর তখনো বাদশা হয়নাই, হে তখন তার চাচা কামরানের লগে থাকে। পাশের এই তসবিওলা ব্যাটাই চাচা কামরান। এইযে তবলা দেখস না পাশে, এই তবলার লাইগা কুস্তি চলতেছে। দুই পুলাই তবলা চায়।

অন্য পুলা কেডা?

ইব্রাহীম। আকবরের চাচতো ভাই। বয়েস একই হইব মনে কর।

সেলিম ছবিতে এক মহিলা কে দেখিয়ে বলল, আর এই বেটি ক্যাডা?

আমি গাল ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে চুল্কে বললাম, কইতে পারিনা। কামরানের হেরেমের কেউ হইব, কিম্বা বউও হইতারে, জানিনা। এইটা নকল ছবি কিন্তু, মিসকিন শা’র আসল ছবি না।

নকল ছবি মানে?

দেইখা দেইখা হাত মকশো করছে আর কি। আসল ছবি আরো আগে কেউ আঁকছে মনে কর। ছবি আঁকা শিখতে হইলে প্রচুর হাত মকশো করতে হয়। তরে মিসকিন শা’র নিজের একটা ছবি দেখাই।

রাজা নায়েলচান্দের দরবারের একটা ছবি বের করলাম, মিসকিন শা এর আঁকা। রাজার যৌবনের ছবি। বুরহানপুরের যুদ্ধের পর বিজয়ীর বেশে তিনি তাঁবুতে বসে আছেন, আর পরাজিত বুরহানপুরের রাজা তার পা চুম্বন করছে। আশপাশে সভাসদবৃন্দ আর সিপাই সান্ত্রী। খুবই জমকালো ছবি। ছবির নিচে বামে দেখা যাচ্ছে কিছু লোকের ভীড়, তার মধ্যে একজনের হাতে একটা খাতার মত। সেইটা দেখিয়ে আমি বললাম, এই বেগুনী পাগড়িওলারে দেখছস? এইটাই মিসকিন শা।

এইটা মিসকিন শা? নিজের ছবি নিজে আঁকছে?

হ। এইটা রাজা নায়েলচান্দের ছবি, এক হারামজাদা জয়চান্দের কথা কইলাম না? এইটা সেই জয়চান্দের বাপ। এই শুয়ারেও এক বিরাট হারামজাদা। যাক, এইটা একটা যুদ্ধ জিতার পরের ছবি মনে কর। রাজায় মিসকিন শা রে দিয়া আঁকাইছে। শুনছি ছবিতে যেরম এই হারু রাজায় হাইরা পায়ে চুমা দিতেছে জিতা রাজার, সেইটা নাকি ভুয়া কথা। হারু রাজার কল্লা আর নুনু কাইটা কিল্লার দরজায় ঝুলায় দিছিল বুলে, পায়ে চুমাচুমির বহু আগেই।রাজা নায়েলচান্দের মনে হয় লজ্জা লাগতেছিল নুনুর ছবি আঁকাইতে, তাই এইরকম ফরমাইশি ছবি আঁকাইছে।

ও ভুয়া ছবি। রাজা নায়েলচান্দে জিতে নাই তাইলে?

না জিতছে, সেইটা ঠিক আছে। কিন্তু জিতার পরে হারু রাজা আইসা পায়ে চুমা খায়া মাফ চাইছে বইলা যেমন দেখতেছি এইটা ঘটে নাই মনে হয়। কিম্বা ঘটছে হয়ত, তারপরে কাটাকুটি হইছে। কে কইতে পারে।

আর খাতা হাতে এইটা মিসকিন শা? নিজের ছবিতে নিজেরে ঢুকাইছে ক্যান?

জানিনা। অনেকে এইরকম এইরকম দরবারী ছবি আঁকার সময় মধ্যে নিজের চেহারা ঢুকায়া দেয়, ছুট কইরা। ভালো কইরা খিয়াল না করলে ধরতে পারবি না। সবসময় হাতে একটা খাতাকাগজ ধরা থাকে, তাইতে বুঝা যায় সে ই আঁকছে ছবিটা।

ছবিতে দুইজনের হাতে খাতা থাকলে?

দুইজনের হাতে খাতা থাকব না। একজনেরই থাকব, যদি থাকে। এই ছবিতে যেরম একজনের হাতেই খাতা, চিপায় দাঁড়ায় রইছে। এই ব্যাটাই মিসকিন শা।

আপনে মিসকিন শা রে দেখসেন? এই ব্যাটা মিসকিন শা আপনারে কে কইল?

আমি আবারও চোয়াল শক্ত করলাম। বললাম, না মিসকিন শা রে আমি দেখিনাই। আমি তার খোঁজ পাওয়ার আগেই সে মইরা গেছে। অরে পাইলে অর…

আমি আর কিছু বললাম না। সেলিম কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে, তারপর চোখ সরিয়ে ছবিটা দেখল একটু। তারপর আবার চোখ তুলে নরম গলায় ফিসফিস করে বলল, মিসকিন শা’য় আপনার কি করছে? আমরা কি এইখানে তার পুলারে খুন করতে আসছি?

আমি অবাক হয়ে বললাম, মিসকিন শা’র পুলা আবার কে? কি কস না কস। মিসকিন শা’র পুলারে আমি মারুম ক্যান, হে আমার কি করছে? বাপের দুষে পুলারে কখনো লাঠি দিতে নাই, কথাটা খেয়াল রাখিস। মিসকিন শা’র পুলা না, আমি মিসকিন শা’র একটা ছবি নিতে আসছি এইখানে। রাজকুমারী চাঁদনিবালার ছবি।

রাজকুমারী চাঁদনিবালা কে?

আমি অজান্তেই খেয়াল করছিলাম আমার বুকে ধুকপুক ধুকপুক বাড়ছে। এই বিষয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। অথবা লাগে হয়ত, সেইটাই হয়ত আমার ভালো লাগে না।

আমি আস্তে করে বললাম, রাজা চোগান সিং এর বড় মেয়ে চাঁদনিবালা। তার বিয়া হইছিল এই জয়চান্দের সাথে, ষুল বছর বয়েসে। বিয়ার সাতদিন পরে চাঁদনিবালা মারা যায়।

অ্যাঁ?

হ। জয়চান্দে তারে পিটায় মাইরা ফেলছিল। কেডা জানি কাঠি দিছিল যে চাঁদনিবালার নাকি আগে বিয়া হইছিল একবার, তারা নাকি চাইপা গেছে। সেইটা শুইনা জয়চান্দ বেত দিয়া সারারাইত পিটাইছিল বউরে, তারপরের দিন জানে মারছিল। আর মারার আগে…

মারার আগে?

আমার গলা শুকিয়ে আসছিল। আমি একটু থেকে আস্তে করে বললাম, রাজা চোগান সিং এর খুব উঁচা বংশ। এই বংশের কোন জেনানার ছবি আঁকার নিয়ম নাই। রাজা জয়চান্দ মারার আগে মিসকিন শা রে দিয়া রাজকুমারী চাঁদনিবালার একটা ছবি আঁকাইছিল। রাজকুমারী বইসা আছে, পিছ ফিরা। হাতের অল্প একটু দেখা যায়, কব্জির উপরে। সেইখানে লাল দাগ, বেতের বাড়ি আর কি।

সেইটা রাজকুমারীর ছবি কেমনে বুঝলেন? হে তো ছিল পিছন ফিরা।

উনার পাশে একটা চুড়ির বাক্স ছিল জহরতের কাজ করা। সেইটা রাজকুমারী চাঁদনিবালা বিয়ার পরে বাপের বাড়ি থিকা আনছিলেন। সবাই সেই বাক্স চিনে। এইটা রাজা চোগান সিং রে অপমান করানোর জন্যই আঁকানো হইছে। এই ছবির খবর চোগান সিং এর কাছে যাওয়ার পর তিনি যুদ্ধ লাগায় দেন, বিরাট ইতিহাস। পরে এই ছবি তিনি হাত করেন। কিন্তু নষ্ট করেন নাই ছবিটা, হাজার হোক তার বড়মেয়ের একমাত্র ছবি।

ও।

সেই ছবি চুরি গেছে দেড়মাস হয়। রাজা চোগান সিং এর বয়েস হইছে, এই খবরে তার খুব পেরেশানী চলতেছে। এই ছবি যে হাত করছে তার মতলব খারাপ। আমি খবর পাইছি ছবিটা এইখানে আছে, এই দূর্গে। সেই ছবির সন্ধানে বাইরামু রাইতে। বুঝছস?

ঘাড় হেলিয়ে সেলিম বলল, বুঝছি তো।

……………………………………………………………………

গভীর রাত।

এই দূর্গের ছক আমাকে তারাবাঈ দিয়েছিল আসার আগে, চিনব সম্ভবত। ভালো করে মুখস্ত করেছি সব। আমার অতিথিশালা হনুমানতোরনের পাশে, সেইখানে একটা চৌকি আছে। সাবধানে পেরুতে হবে জায়গাটা। আরেকটু এগুলে দেবভবন, দশটা মন্দির সেইখানে। মন্দিরে রাতে লোকের আনাগোনা কম নিশ্চয়। তার পাশ দিয়ে আরেকটা চৌকি, তার পাশে ঢাল। পুকুর আছে একটা, সেই পুকুরে নাকি চোদ্দটা কুমির! যাক আমার কি, আমি তো আর পুকুরে নামছি না। আমাকে এগুতে হবে আরো সামনে, রাজভবনের পাশে দিয়ে। সেইখানে আসলাম মহাজনের কুঠি।

পৌঁছে একটা গাছের পিছনে কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে বসে দেখলাম কোন আওয়াজ শোনা যায় কিনা। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে খিড়কি দরজার দিকে গিয়ে ঠেলা দিলাম। আশ্চর্য, দরজা খোলা কেন? আসলাম মহাজন তো দরজা না লাগিয়ে ঘুমাতে যাবার কথা নয়। ভুল বাড়িতে এলাম নাকি?

কোমরের ছুরি বের করে সাবধানে এগুলাম, শব্দ শোনা গেল কি? কিসের শব্দ ঐটা?

আমি উঁকি দিলাম ঘরের ভিতর। অন্ধকার তখন চোখে সয়ে এসেছে, কেউ একজন ভিতরে গোঙ্গানির মত আওয়াজ করছে। আমি একটু চিন্তা করলাম, ব্যাপার কি?

এমন সময় ধুপ ধুপ শব্দে কেউ দৌড়ে পালাল। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, আমি দ্রুত সামনে উঠানে এসে শব্দ বরাবর ছুরি ছুঁড়ে দিলাম। আমার ঘাড়ের পিছনে ছুরি রাখা থাকে, উলটো করে। ফলাটা উপরের দিকে। চোখ বেঁধে শুধুমাত্র শব্দ শুনে আওয়াজ বরাবর ছুরি ছুঁড়ে নিশানা করা আমার জন্য কঠিন নয়। কিন্তু দৌড়ের শব্দ থামল না, “আঁউক” শব্দ করে কেউ একজন ছুটে পালিয়ে গেল তবু। আমি ধরতে পারলাম না কোনদিকে গেল।

ধুর শালার।

তবে ঐ দৌড় আসলাম মহাজনের নয় সেইটা আমি নিশ্চিত, সেই লোকের দুই মণী ভুঁড়ি নিয়ে এরকম ফৌজি সিপাইয়ের মত দৌড় দেওয়া অসম্ভব। তাহলে কে ছিল লোকটা? আমি আবার ঘরে ঢুকলাম। কেউ একজন ক্ষীণ গোঙ্গাচ্ছে ঠিকই। আমি কক্ষের ভিতর ঢুকে জানালা অল্প খুলে দেখি আসলাম মহাজন মরে পড়ে আছে, তার রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘর।

আমি দ্রুত চিন্তা করলাম। আমি তো এই লোককে ডাণ্ডা মারার কথা, এ অন্য লোকের ছুরি খেল কেন? বিষয়টা কি? আমি এখন ছবি পাই কোথায়? এই লোক ছাড়া আর কে জানে ছবির খবর তা তো আমি জানিনা। ভারি মুস্কিল হল।

এমন সময় আবার গোঙ্গানীর শব্দ হল। আরে ব্যাটা মরে নাই তো, বেঁচে আছে। আমি লাফ দিয়ে পড়ে তার মাথা তুলে বললাম, কে? কে করছে এই কাজ মহাজন? কে আপনেরে মারল?

ঘড়ঘড় শব্দ করল আসলাম মহাজন। এ কি আমার কথা বুঝছে?

আমি আবার ঝুঁকে বললাম, মহাজন মিসকিন শা’র ছবি কই? রাজকুমারী চাঁদনিবালার ছবি কই?

স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল আসলাম মহাজন, তারপরে কাঁপা কাঁপা হাত তুলে নিজের চোখে হাত দিয়ে কি একটা দেখাল। মুখে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে না পেরে ধপ করে মাথা কাত করে পড়ে গেল।

মরে গেছে হারামজাদা।

সেইটা ঠিক আছে, সে আমার হাতে সম্ভবত মরতই। কিন্তু এখন ছবি পাই কই? কে দৌড়ে পালাল আসলাম মহাজনকে খুন করে?

পরিকল্পনা এইভাবে ভচকে যাবে আমার মাথায় আসেনি। পালানো যাক আপাতত, রক্তে ভরা জামা নিয়ে দিনের আলো হবার আগেই ঘরে ফেরা জরুরী। কোন একটা পুকুরে গিয়ে শব্দ না করে নিজেকে ধুতে হবে এখন।

আমি বেরিয়ে পড়লাম পাছদুয়ার দিয়ে। মাথার ভিতরে একশোটা জিনিস ঘুরছে। মহাজন চোখে কি দেখাল? তাকে মারল কে? কেনই বা মারল? ছবি কোথায়? যে মেরেছে সেই কি ছবি নিয়েছে না ছবির খবর মহাজন পেটে রেখে অক্কা পেল? ধুর।

রাজভবনের পিছন দিয়ে যাবার পথে একটা ছোট পুকুর আছে। পাশে মাঝারি আকারের একটা প্রাসাদ। সেই প্রাসাদে থাকে রাজা জগৎ সিং এর বিমাতা পিয়ারি, এবং তার দুই ছেলে নয়ন প্রতাপ আর সাগর প্রতাপ। এর পরের পুকুরে কুমীর আছে সম্ভবত, এই পুকুরেই জামা ধুয়ে নেয়া যাক দ্রুত।

ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। দূরে কোথাও চৌকিখানায় হেই হো আওয়াজ শোনা গেল। আমি আস্তে আস্তে হাত ধুচ্ছিলাম, হঠাৎ চমকে তাকালাম পাশের প্রাসাদের দিকে। বিদ্যুচ্চমকের মত আমার মনে পড়ে গেল আসলাম মহাজন হাত দিয়ে চোখের দিকে দেখাচ্ছিল আমি যখন ছবির কথা জানতে চেয়েছিলাম। চোখের দিকে! চোখ! নয়ন!

নয়নপ্রতাপ!

আম্মিজানের ছবি নয়নপ্রতাপের হাতে!

(চলবে)


Comments

নিহন আহসান's picture

হাততালি

সত্যপীর's picture

চাল্লু

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক's picture

কবুতর ফারুক ইজ ব্যাক ইন বিজনেস

---ইমরান ওয়াহিদ

সত্যপীর's picture

কথা সত্য মিয়াভাই। নয়নপ্রতাপের খবর হ্যাজ।

..................................................................
#Banshibir.

Sohel Lehos's picture

গল্প জমছে পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

সত্যপীর's picture

কৈতেছেন?

..................................................................
#Banshibir.

মেঘলা মানুষ's picture

কবুতর ফারুক ইন মিশন! মার মার কাট কাট!

সত্যপীর's picture

হ। কেবল তো শুরু।

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক's picture

কবুতর ফারুক ইজ ব্যাক দেঁতো হাসি পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম
ইসরাত

সত্যপীর's picture

ইষ্টে টিউন্ড।

..................................................................
#Banshibir.

মরুদ্যান's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তয় হিউমার একটু কম হইসে মনে লয়! চিন্তিত

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

সত্যপীর's picture

খুবই গম্ভীর মুখ কইরা লিখছি তাই, হাসি হাসি মুখ কইরা লিখলে দেখতেন হিউমারে ভাইসা যাইতেছে।

..................................................................
#Banshibir.

মরুদ্যান's picture

দেঁতো হাসি

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

স্পর্শ's picture

গল্প জমাটি হচ্ছে! চলুক


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

সত্যপীর's picture

তইলেই চলব।

..................................................................
#Banshibir.

তারেক অণু's picture
সত্যপীর's picture

পপ্পন বাদ্দিয়া ঝাল পিঠা খান।

..................................................................
#Banshibir.

তিথীডোর's picture

জোশ! উত্তম জাঝা!
পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম নিয়ে বসলাম, টার্কি খেতে খেতে পরের পর্ব জলদি লিইখ্যা ফালান।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সত্যপীর's picture

আমরা অক্টোবর মাসেই টার্কি খাইয়া থাকি গো বৈনডি, আমরার টার্কি দিবস কালা শুক্কুরবার এগুলি আলাদা।

মুর্গি খাইতে খাইতে লেখতে বাধা নাই অবশ্য।

..................................................................
#Banshibir.

সুলতানা সাদিয়া's picture

আপনার লেখার ধরণটা আলাদা। খুব মনের সাথে চোখের প্রগাঢ় বন্ধন লাগে। শুভকামনা রইল। লেখা চলুক।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

সত্যপীর's picture

হ্যাঁ কবুতর ফারুকের গল্পগুলি হইল সামাজিক অ্যাকশনধর্মী, কাজি হায়াতের সিনেমাগুলির মতন। খুবই ভিজ্যুয়াল, মনের চোখের বন্ধন তো লাগবেই খাইছে

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক's picture

শুভকামনা রইলো। অনিঃশেষ।

ভালো লাগার কথা জানালাম।

দীপংকর চন্দ

সত্যপীর's picture

ধন্যবাদ দীপংকর চন্দ। ভালো থাকুন।

..................................................................
#Banshibir.

ইয়াসির আরাফাত's picture

হাততালি চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

সত্যপীর's picture

পপ্পন খাইতে খাইতে হাত্তালি দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ না কিন্তু।

..................................................................
#Banshibir.

ইয়াসির আরাফাত's picture

আমি একসাথে মাল্টিপল অ্যাকশনে যাইতারি না। প্রথমে পপ্পন মাইক্রোওয়েভে ঢুকাইছি (ইমো নাই)। তারপর হাত্তালি দিছি। তারপর বুড়াঙ্গুল দেখাইছি। এরপর পপ্পন হইয়া আইলে আয়েশ কইরা প্যাকেট হাতে সোফায় বসলাম। দেঁতো হাসি

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.