সাকরাইন

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Wed, 15/10/2014 - 5:50pm
Categories:

বাকাট্টা বাকাট্টা হৈহৈ হৈহৈ। প্রবল চিৎকার চ্যাঁচামেচির মাঝে একটা সপ্নের পতন। সাকরাইন। পুরান ঢাকার পৌষ সঙ্ক্রান্তির উৎসব। ঘুড়ির উৎসব। যখন সাকরাইনের কথা মনে পরে যায় মনে হয় আগের জন্মের কোন মধুর সপ্ন দেখে এই মুহূর্তে জেগে উঠলাম। পৌষের শেষদিন জানুয়ারির মাঝামাঝি ১৪ বা ১৫ তারিখ। চারদিকে শুধু ঘুড়ি,ঘুড়ি আর ঘুড়ি। সাদা, হলুদ, লাল,নীল, বেগুনি গোলাপি সবুজ কোন রঙ নেই তাই খুজে দেখার মত।

কোনটা দেখতে যেন মানুষের মুখ, কোনটা মাছ, কোনটা প্রজাপতি, কোনটা পাখি,কোনটা লেজ ঝোলা আবার দেখা গেল কোনটার লেজই নেই।

প্রায় একযুগ আগে আমার দেখা শেষ সাকরাইন। প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত এই অক্টোবরের শেষ থেকেই। আমাদের পুরান ঢাকার বাসার সামনের এক ল্যাম্প পোস্ট থেকে আর এক ল্যাম্প পোস্ট পর্যন্ত সুতো বেধে কাঁচের গুড়ো আর রঙ মিলিয়ে মাঞ্জা দেয়া। যত ভাল মাঞ্জা হবে তত খাচাং করে ঘুড়ি কাটবে। তখন থেকেই দল বেঁধে বিভিন্ন ছাদে ঘুড়ি উড়ানোর চর্চা করা। আর এক পাড়ার ছেলেদের আর এক পাড়ার দিকে ছুড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জ। একদল ছাঁদে ঘুড়ি উড়ানোর চর্চায় ব্যস্ত তো আরেকদল লম্বা বাঁশের মাথায় কাপড় আর ছোট ছোট ডাল বেঁধে কিম্ভুত একটা ঝাড়ু ধরনের জিনিস বানিয়ে তাই নিয়ে এক ছাদ থেকে আর এক ছাদ দৌড়ে আকাশের ঘুড়ি মাটিতে নামিয়ে আনার চেষ্টা। হেমন্তের পরিষ্কার আকাশে অদ্ভুত ধরনের রঙের খেলা।

আমি ইউসুফ চাচার সাথে সাকরাইনের ঘুড়ি কিনতে যেতাম চৌধুরীর দোকানে সেই দোকানটা ছিল যেন একটা গুপ্তধন ভর্তি গুহা। কি নেই সেই দোকানেবড়, ছোট মাঝারি ঘুড়ি, নাটাই, রঙ, মাঞ্জা দেবার সব কিছু আরও থাকতো লুডো, লাট্টু, চকলেট, লজেন্স, নানা প্লাস্টিক এর পুতুল খেলনা,চক স্লেট। পুরনো আধো অন্ধকার সেই দোকানটাতে ঢুকলেই কেমন একটা উত্তেজনা হত বুকের মাঝে কেমন যেন ছমছম। সাদা চুল সাদা দাঁড়ি সাদা পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পড়া বুড়ো চৌধুরী সাহেব মাথায় সাদা টুপি পরে ফোকলা দাঁতে হাসতেন আমার ছুটো-ছুটিদেখে। সে গল্প না হয় আর একদিন করব। বছরে এই একবার ই একটা ঘুড়ি কিনতে পারতাম। মাঝে মাঝে কাগজ কেটে ঝাড়ুর কাঠী আটকে নিজেই ঘুড়ি বানিয়েছি কিন্তু উড়াতে পারতাম না। আমাদের বাসায় ঘুড়ি উড়ানোর অনুমুতিছিল না। বারেক দাদুর ২ ছেলে ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে ছাদ থেকে পরে মরে গিয়েছিলো। সাকরাইনের দিনে প্রায় প্রতিবছরই এমন ভয়ঙ্কর কিছু শুনতে পেতাম।তাই বাসা থেকে ঘুড়ি উড়ানোর কোন উপায় ছিলনা।

দেখতে দেখতে প্রস্তুতির শেষ। একদিন আসল দিনটা চলে আসত । পরন্ত শীতের দিনে সাকরাইন, পৌষ সংক্রান্তি।উৎসবে মাতোয়ারা পুরান ঢাকা। অনেক জোরে বিভিন্ন ছাদে গান বাজত। ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে’থেকে ‘সেই তুমি কেন অচেনা হলে’ কোন গানটা না বাজত। একদল ঘুড়ি নিয়ে আর একদল সেইলম্বা বাশের ঝাড়ু নিয়ে এক টিনের চাল থেকে অন্য টিনের চালে ছোটাছুটি। পাশের বাসার চাহিন চাহিদের মা(শাহিন শহিদের মা) যাকে সারাজীবন আমি এই নামেই চিনেছি, তার ভাঙ্গা টিনের চালে কেউ ঘুড়ি উড়ালে বা ঘুড়ি ধরতে উঠলেই চিৎকার করে উঠত। একবার শুরু হলে আর থামার নাম নেই এমন চিৎকার।

সকাল থেকে একেবারে সূর্যাস্তের সময় পর্যন্ত সব ছাদে ছেলেদের ঘুড়ি উড়ানো। হরেক রকম খাওয়া দাওয়া।সূর্যাস্তের পর মুখে কেরসিন নিয়ে মশালের দিকে ছুড়ে দিয়ে রোমাঞ্চকর অদ্ভুত আগুন নিয়ে খেলা। আমাদের পাড়ায় এই খেলাটা দেখাতো রত্না আর সোলে (রতন আর সোলায়মান) এদেরকে তখন মনে হতো সুপারম্যান বা স্পাইডারম্যান জাতীয় কোন সুপার হিরো। আগুন খেলার মাঝ দিয়ে একটু একটু মন কেমন করা অনুভুতিতে একবছরের জন্য সাকরাইনের বিদায়।

আমার জন্য এই দিনটা সবসময়ই খুব অন্যরকম বিশেষ একটা দিন। পুরোটা আকাশ জুড়ে লাল নীল সবুজ সাদা শত শত ঘুড়ি। মাঝে মাঝে মনে হত এক একটা মুখ, এক একটা চরিত্র। সবাই যেন আমার বন্ধু। কখন খুব কাছে এসে আবার অনেক দূরে উড়ে উড়ে আমার সাথে গল্প করত।কেউ কেউ দেখতে যেন খুব হাসি খুশি, কেউ গোমড়া মুখো কেউ যেন দুষ্ট দুষ্ট, কোনটা আবার একটু ভারিক্কী।কখনো কখনো ওরা যেন বারেক দাদুর মরে যাওয়া দুই ছেলে। হেসে হেসে বলতো এই দেখ ঘুড়ি উড়াতে উড়াতে কখন আমরা নিজেরাই ঘুড়ি হয়ে গেছি।কোন টাকে আমার কল্পনার বন্ধু দিমকাও মনে হতো। কেউবা কিশোর কেউ রবিন কেউ বা মুসা কিংবা ফেলুদা। কোনটাকে মাঝে সাঝে আপুনি ও মনে হত, হয়ত অনেক ছোট বেলায় আমাকে ছেড়ে দূরে চলে গেছে তাই।

সব থেকে বেশি যেটা মনে হত সেটা হল এক একটা ঘুড়ি যেন আমার এক একটা সপ্ন। কাছে থেকেএকটু একটু করে অনেক উপরে উঠতে উঠতে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যেত ভয় লাগত এই বুঝি স্বপ্নটা হারিয়ে গেল। আকাশে উড়তে থাকা শত শত সপ্নের মাঝেকিছু কিছু হয়ে যেত বিশেষ আপন।হারিয়ে যাবার ভয়ের মাঝে একটাই সস্তি সুতোটা মাটিতেইআছে। মাঝে মাঝে কিছু সপ্নের সুতো কেটে মুখ থুবড়ে পরে যাওয়া। নিজের জীবনটা যেন প্রতীকী রুপে একেবারে সামনে চলে আসতো।

আর হয়ত কখনই আমার পুরান ঢাকায় সাকরাইনের উতসবে মেতে ওঠা হবে না হয়ত উৎকণ্ঠা নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আকাশের দিকে চেয়ে ঘুড়ির কাটাকুটি খেলা দেখা হবে না। কিন্তু সপ্ন ঘুড়িগুলো সবসময়ই মনের আকাশে উড়ে বেড়াবে। কেউ কেউ হয়ত কষ্ট দিয়ে অকালেই মুখ থুবড়ে পরে যাবে। কেউ বা বীরদর্পে মাথাতুলে দাড়িয়ে থাকবে। কাউকে হয়ত নিজেরই পুড়িয়ে ফেলতে হবে মনের সাকরাইনের মশালের আগুনে।। সবকিছুর পরেও ওই বীরদর্পে মাথা তুলেদাড়িয়ে থাকা ঘুড়ি গুলোই আমাদের বেচে থাকার কারন.. আর আকাশের ছোট বড় মাঝারী সব রঙের ঘুড়ি গুলোকে নিয়েই তো এই আনন্দময় জীবন।

Deshantori oporichita
nzh


Comments

রিক্তা's picture

ভালো লেগেছে। স্বপ্ন বানানটা ঠিক করে দিয়েন প্লিজ।

--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

মেঘলা মানুষ's picture

অতিথি লেখকের বানান ঠিক করার উপায় নেই, কেবল মডারেটর কিছু করতে পারেন।

@লেখক: লেখা ভাল লাগলো। তবে, লেখার শেষে আপনার বাংলা 'নিক' টা রোমান হরফে লেখার কারণটা বোঝা গেল না। এটা বাংলায় দিলেই সুন্দর হত।

শুভেচ্ছা হাসি

এক লহমা's picture

লেখা ভাল লেগেছে। বানান, দুটি শব্দের মাঝের ফাঁক - এই বিষয়গুলিতে আর একটু যত্ন নিতে অনুরোধ রইল।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মরুদ্যান's picture

চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

সুলতানা সাদিয়া's picture

এক টুকরো স্মৃতিকথা ভাল লাগলো।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক's picture

ভালো লাগা রইলো।
দুই তিনবারের সাকরাইনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে মনে।

শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ।

দীপংকর চন্দ

নজমুল আলবাব's picture

খুব ভালো লাগলো

অতিথি লেখক's picture

আমি অবশ্য বাকাট্টা শব্দটা জানতাম না। জানতাম "ভোকাট্টা" ।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.