কোরবানী স্পট

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Tue, 30/09/2014 - 2:58am
Categories:

বিভিন্ন ফর্মের মধ্যে, উচ্চতা আর ওজনের পাশাপাশি সনাক্তকারী চিহ্ন লিখতে হয়। আমি সবসময়েই ওখানে লিখি, ডান চোখের পাশে কাটা দাগ। এই সনাক্তকারী চিহ্নের পেছনে একটা দুঃখজনক এবং শিক্ষামূলক গল্প আছে।

২০০৬ সালের কোরবানীর দুদিন আগে, কুমিল্লার উত্তর চর্থা এলাকায়, কিছু লোকাল গুণ্ডা আমাকে ধরেছিলো মোবাইল হাইজ্যাক করার জন্য। কোরবানীর সময়টা এমন যে, সবার হাতে দা-ছুরি-চাপাতি থাকে। ঐ সময় ওগুলো হাতে নিয়ে হনহন করে হাঁটুন, কেউ আপনাকে কিছু বলবে না। তারাও ওগুলো হাতে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরছিলো।

সন্ধ্যার সময়, অন্ধকার রাস্তায়, এমন একজন আমার পিছু পিছু হাঁটছিলো। আমি একটু সতর্ক হয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম, সে দৌড়ানো আরম্ভ করলো।হঠাৎ সামনে থেকে আরো দুইজন আমাকে ধরলো। এই দুইজনের একজনের হাতে পেছনের ছেলেটার মত চাপাতি ছিলো। জানিনা, এরা নেশাগ্রস্ত ছিলো কিনা, আর নেশার ঘোরেই আমাকে ধরেছিলো কিনা। কাছে এসেই "ঐ, মোবাইল দে" বলেই পেছন থেকে আসা ছেলেটা আমার মাথায় আর আরেকজন আমার গায়ে কোপ দিলো। আমি "বাঁচাও, বাঁচাও" বলে চিৎকার করছিলাম, আর ওরা কোপ দিতেই থাকলো...... আমি যে মোবাইলটা দেবো, সেই সুযোগটাও আমাকে দেয়নি। লেদারের জ্যাকেট পড়া না থাকলে ঐদিন হয়তো মারা যেতাম নাড়ী-ভুঁড়ি বের হয়ে। তবে মাথা থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছিলো।

যাই হোক, কয়েকটা কোপ খেয়ে আমার মাথা একদম শান্ত হয়ে গেলো। কোপ তো খেয়েছিই, মোবাইল দেয়ার আর কোনো মানে হয় না। মোবাইলটা যে হাতে (ডান হাতে) মুঠ করে ধরা ছিলো, সেই কনুই দিয়ে একজনের গলায় বাড়ি দিয়ে, সাথে সাথে অন্যজনের কান বরাবর একটা ঘুষি চালালাম। যার হাতে কিছু ছিলো না, সে পেছন থেকে আমার বাম হাত ধরে রেখেছিলো। আমার বাম হাতটা তাকে সহ টেনে আরেকজনের গায়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। চেষ্টা করছিলাম, তাদের চাপাতিটা নিজের হাতে নেয়ার। নিতে পারলে ঐদিন আমার হাতে কী যে হতো, কে জানে? এরকম কিছুক্ষণ করার পর তারা পালালো। আমি বাসায় গেলাম না, আম্মু প্যানিক করবে বলে। কাছেই দারোগাবাড়ীতে মইনু স্যারের বাসা ছিলো, আর বাসার কাছেই দোকান। এক দৌড়ে ওখানে গেলাম। উনি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। মাথায় সাতটা সেলাই লেগেছিলো, চোখের পাশে দুটো...

কেন ঘরে ঘরে এবং প্রকাশ্যে কোরবানী না হয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় কোরবানী হওয়া উচিৎ, তার প্রথম কারণ এটা। এ ধরনের অস্ত্র প্রকাশ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়াবার লাইসেন্স পেয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে দেবে, কোরবানীর জন্য।

দ্বিতীয় কারণটাও কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটা হচ্ছে, শিশু-দুর্বলচিত্তের নারী-পুরুষদের মানসিক অবস্থা। আজকে একজনের সাথে কথা হচ্ছিলো, সে কোরবানীর সারাদিন কিছু খেতে পারেনি; কারণ, সকালবেলা ভুল করে বারান্দায় গিয়ে গরুর জবাই করা দেখে ফেলেছিলো। বাচ্চাদের ওপর এটা অনেক বিরুপ প্রভাব ফেলে, অবচেতনভাবে এটা হিংস্র হয়ে ওঠার বীজ বোনে। হিন্দুদের বলি দেয়ার সিস্টেমটাও প্রকাশ্যে করা উচিৎ নয়, ঠিক এই কারণে।

তৃতীয় আরেকটা কারণ হচ্ছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। সারা শহরের যে কি বাজে অবস্থা থাকবে আরো কয়েকদিন, আপনারা সবাই জানেন। সবাই ময়লা করতে জানে, কিন্তু পরিষ্কার করার বেলায় কেউ নেই। সবদিকে রক্ত, সবদিকে হাড্ডি, ম্যাসাকার পরবর্তী পরিস্থিতি। নির্দিষ্ট করে দেয়া কিছু জায়গায় কোরবানী হলে সেটা সহজেই ম্যানেজ করা যাবে। কোরবানীর আগে এ ধরনের স্পটের জন্য কিছু বাজেট বরাদ্দ করলে, সিটি কর্পোরেশনের কোরবানে-পরবর্তী-বাজেটও অনেক কম লাগবে।

চতুর্থত, চামড়া ব্যবসায়ীরাও এটা থেকে লাভবান হতে পারবে। তাদেরকে পুরো শহর ঘুরে বেড়াতে হবে না। নির্দিষ্ট ঐ জায়গাগুলো থেকেই তারা চামড়া যোগাড় করে নিতে পারবে।

....................... নিজের ঘরে কোরবানী করাটা ব্যক্তিগতভাবে সহজ, কিন্তু সামাজিকভাবে চিন্তা করলে কোরবানী বা বলির জন্য নির্দিষ্ট কিছু সাইট ঘোষণা করাকেই শ্রেয় বলে আমি মনে করি। উন্নতবিশ্বে এমনটাই হয়ে আসছে অনেক বছর ধরে। আচ্ছা, ওখানে না হয় মুসলিম কম, কোরবানী কম হয়। যারা কোরবানী দেন, তারা তো নিশ্চয়ই ইসলাম মানেন। ইসলামেই এ ধরনের বিশেষ স্থানের কথা উল্লেখ আছে (পড়েছি, সত্যি-মিথ্যা জানিনা)।

আগে নাকি নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানী করে পশু ফেলে রাখতে হতো। যাদের কোরবানী আল্লাহ কবুল করতেন, তাদের পশুর ওপর বজ্র এসে সেটাকে নাকি ঝলসে দিতো। Too bad যে এই সিস্টেমটা বন্ধ হয়ে গেছে!! নইলে ঠিকঠাক বোঝা যেতো, কয়জন সঠিক কায়দায় সঠিক উদ্দেশ্যে কোরবানী দিচ্ছে। আর বোঝা যাক বা না যাক, ওপরের চারটা সমস্যা সমাধান তো নিশ্চয়ই হতো।

সরকারী তরফ থেকে এই ধরনের জায়গা নির্দিষ্ট করার জন্য উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। অনেক মসজিদেরই বিশাল বিশাল মাঠ থাকে, সেগুলো ব্যবহার করা যায়। ঈদের নামাযের পর ঈদগাহ ময়দানও ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। স্কুল-কলেজের মাঠও প্যান্ডেল দিয়ে ঘেরাও করে কোরবানী স্পট চিহ্নিত করা যেতে পারে। তাহলে হাতের কাছেই কোরবানীর জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা পাওয়া যাবে, কাউকেই বেশিদূর গরু বা মাংস টানাটানি করতে হবেনা। একবার শুনেছিলাম, এ ধরনের ব্যবস্থা নাকি নেয়া হবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে, কিন্তু সেটার আর কোনো অগ্রগতির খবর শুনলাম না। একদিন না একদিন, এই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবেই, এই কামনায়......

- ফরহাদ হোসেন মাসুম


Comments

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

গরু-ছাগলতো সারা বছরই কেটে মাংস বিক্রি করা হচ্ছে, খাওয়া হচ্ছে, তখন কি এইসব সমস্যা হয়? হয় না। তাহলে সারা বছর যেখানে গরু-ছাগল কাটা হচ্ছে ঈদের সময় সেখানে কোরবানী দিতে অসুবিধা কোথায়? কোরবানীর বিধানে কি এমন বলা আছে যে, যার যার নিজের বাড়ির আঙিনায় বা রাস্তায় কোরবানী দিতে হবে?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তাহসিন রেজা's picture

আপনার ছিনতাইয়ের কবলে পড়ার অংশটুকুতে ভয় পেলাম।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

বন্দনা's picture

সিঙ্গাপুরে দেখেছি লোকজন মসজিদে টাকা দিয়ে দেয় কোরবানীর জন্য। মসজিদের তত্বাবধানে পরে কোরবানী দেয়া হয় । আমাদের দেশে ও এমন হলে যেখানে সেখানে গরু কাটা বন্ধ করা যায় হয়তো। যতদিন দেশে ছিলাম, আমি নিজে ও খুব মন খারাপ করতাম, কোরবানীর ঈদ পছন্দ করতাম না। গরু কাটাকাটি দেখতে পারিনা চোখের সামনে, জবাই হবার অপেক্ষারত গরুর করুন যেই চোখ দেখলেই কেমন লাগতো যেন।যদিও মাংস খাইনা তা না, কিন্তু এমন গনহারে কাটাকাটি দেখলে বাচ্চা তো বাচ্চাই বড় মানুষের মনে ও এর প্রভাব পরে।

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

সবই ঠিকাছে, তয় পাবলিক নুইস্যেন্স হইতে ধর্মানুভূতি* অধিক গ্রহণযোগ্য।

( *শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা সাপেক্ষে প্রযোজ্য )

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সত্যপীর's picture

আপনে মন্ত্রী হইলে আইজই আপনের চাকরি যাইত মন খারাপ

..................................................................
#Banshibir.

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

হো হো হো গতকাল নাকি "বিশ্ব ব্লাস্ফেমী অধিকার দিবস" আছিল চোখ টিপি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নীড় সন্ধানী's picture

আপনি এইসব কী বলেন? বাংলাদেশ হলো স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কোরবানীর সময়টা তো গণতন্ত্র প্রদর্শণের চুড়ান্ত সময়। যেখানে সেখানে গরুর হাট, রাস্তাঘাট বন্ধ, ঈদের দিন যেখানে যার খুশী ছুরি চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গরু ছাগল কোরবানী করবে, রাস্তাঘাট নালানর্দমা খালবিল পশুবর্জ্য দিয়ে ভরিয়ে ফেলবে। সেই বর্জ্য পরিষ্কার করার জন্য সিটি বাহিনীর টাস্কফোর্স তৈরী থাকবে প্রধান শহরে। সেই টাস্কফোর্স কিছু পরিষ্কার করবে, বাকীগুলা বৃষ্টির অপেক্ষা করবে। ততক্ষণে কয়েক হাজার বিলিয়ন গণতান্ত্রক জীবানু বাতাসে পর্যটন করবে, কিছু কিছু মানুষের ফুসফুসে আর রক্তে বাসাবাড়ি করবে। তারপর ডাক্তার হাসপাতাল ডায়গনস্টিক সেন্টার এসবের বাণিজ্য চলবে। দেশের অর্থনীতির চাকা তো এভাবেই ঘুরে। তাছাড়া অপরিচ্ছন্নতা বিশৃংখলা আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতির অংশ, আমাদের শত বছরের লালিত ঐতিহ্য। এটা নিয়ে কিছু বলা অনুচিত। আসেন ভাই চুপ থাকি।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.