স্বাধীনতা স্তম্ভ মোনাস, তামানমিনি ইন্দাহ আর রাতের জাকার্তায়

সৈয়দ আখতারুজ্জামান's picture
Submitted by Syed Akhteruzzaman on Sat, 19/04/2014 - 10:52pm
Categories:


আগে সাহস করে একথা বলতে পারতাম কিনা জানিনা। তবে এখন বলতে পারি, ‘তামানমিনি’ না দেখলে জাকার্তা দর্শন অসম্পূর্ণ’। পুরো নাম ‘তামানমিনি ইন্দাহ’। এক কথায়, মিনিয়েচার ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়ার ৩২টি দ্বীপরাজ্যের এক সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের পার্ক। দ্বীপ বাসিন্দাদের ঘর-বাড়ির অনুরূপ মডেল-বাড়ি আর তাদের জীবন যাপনের নানা ব্যবহার্য উপাদান দিয়ে এক অনবদ্য উপস্থাপনার নাম ‘তামানমিনি’।

আমরা আছি জাকার্তার জালান জাকসা রোডের এক হোটেলে। এখান থেকে তামানমিনি যেতে খুব বেশি হলে ৩০ মিনিট সময় লাগে। গত কয়েকদিন ধরে নানা সময়ে এই রোডে হাঁটাহাঁটি করেছি। পছন্দসই খাবারের দোকান, কিংবা কলিং কার্ডের দোকান বা বই-ম্যাগাজিনের দোকান খুঁজেছি। নানা জনের কাছ থেকে জার্কাতার গল্প শোনার চেষ্টা করেছি। এই ঘোরাঘুররির মধ্যে ‘আদে’ বলে এক বন্ধু জুটে গেলো। আজকে সকালে রেস্টুরেন্টে নাস্তা করতে ঢুকেই আদে'র সাথে দেখা। পাশেই তার ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা। তার কাছ থেকে তামানমিনি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানতে পারলাম। ১৯৭০ সালে ইন্দোনেশিয়ার সাবেক ফার্স্টলেডি ত্যেন সুহার্তোর উদ্যোগে তামানমিনি তৈরির কাজ হাতে নেয়া হয়। তার একান্ত বাসনা ছিলো ইন্দোনেশিয়ার বৈচিত্রময় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পোশাক, নৃত্য, দ্বীপের অধিবাসীদের জীপন-যাপনের নমুনা তুলে ধরা। যাতে বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা পর্যটকরা সারা দেশ ঘোরার সময় না পেলেও কেবল তামানমিনি ঘুরে ইন্দোনেশিয়া সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা পায়। প্রথমে ২৬টি দ্বীপরাজ্যকে তুলে ধরে তামানমিনির যাত্রা শুরু হলেও এখন মোট ৩২ রাজ্যের নামে বিশাল আকারের প্যাভিলিয়ন আছে। ২৫০ একর জমি নিয়ে এই এলাহি আয়োজনে কত যে কিছু আছে নাকি ইয়াত্তা নেই। বানাতে সময় লেগেছে দশ বছরেরও বেশি। তামানমিনি সম্পর্কে আদে’র বক্তব্য হলো, এক সপ্তাহ সময় হাতে নাও, তামানমিনি দেখতে যাও। মুন্না আমাকে বাংলায় বলল, এই ব্যাটা গুল মারছে। চল নিজেরাই গিয়ে দেখে আসি। নাস্তা শেষ করে আয়েশ করে এক কাপ চা খেলাম। মুন্না ইতিমধ্যেই হাত তুলে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়েছে। অবশ্যই ব্লুবার্ড ট্যাক্সি। উঠে পড়লাম ট্যাক্সিতে। জাকার্তায় এক কাপ চা না বলে এক বালতি চা বলা ভালো। বিশাল এক গ্লাসে করে পুরো একগ্লাস ভরে লাল চা পরিবেশন করে। মুন্না প্রথমবার দেখে আতকে উঠে বলেছিলো - এইটা কি? চায়ের ভেতর আবার একধরণের সুগন্ধি পাতা ভাসছে। আমার খেতে তো ভালোই লাগে। মুন্না ওয়াক্ ওয়াক্ করতে করতে গ্লাসটা ঠেলে সরিয়ে দিলো। পাশেই ছিলো বাংলাদেশের ইন্দোনেশিয়া দূতাবাসের বড়ভাই সিরাজ ভাই, তিনি বললেন, ফালায়েন না, আমি খাই, এতগুলা টাকা, এইখানে চায়ের অনেক দাম। এককাপের দাম পাঁচ হাজার টাকা। পাঠক, আপনি চমকাবেন না। ইন্দোনেশিয়ার মুদ্রার মান বাংলাদেশি টাকার তুলনায় অনেক কম। একশ বাংলাদেশি টাকায় আপনি মোটামুটি পনের হাজার ইন্দোনেশিয়ান রুপি পাবেন। এক কাপ চা পাঁচ হাজার টাকা মানে বাংলাদেশি টাকায় কাপ প্রতি ৩০ টাকার মতো। ঘন্টা খানেক ট্যাক্সিতে চড়লে আপনার তিন চার লাখ টাকা নাই হয়ে যাবে। বাংলাদেশ থেকে যে-টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম তাতে ইন্দোনেশিয়া গিয়ে নিজেদেরকে প্রায় কোটিপতি ভাবতে শুরু করলাম। এত টাকা করি কী? সবচেয়ে ছোট নোটও এক হাজার টাকার, এরপর নিচে সব খুচরা পয়সা।

সে যাই হোক, তামানমিনির গল্পে ফিরে আসি। আমাদের ট্যাক্সি মাঝেমাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ছে।
মুন্না বলল, "পা-সুপির (মানে ড্রাইভার সাহেব), কী সমস্যা? এত ট্রাফিক জ্যাম কেন? আমরাতো জানি ট্রাফিক জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই।"
ড্রাইভার বলল, "এটা ট্রাফিক জ্যাম নয়। এটা টোলের লাইন।"
আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। জাকার্তার প্রায় সকল বড় রাস্তায় চলাচল করতে টোল দিতে হয়। তামানমিনি যাওয়ার পথে এই টোল প্লাজার সংখ্যা একটু বেশি।

জাকার্তার রাস্তা অসাধারণ মসৃন। গাড়ি চলার সময় চাকার একটা স্বাচ্ছন্দ্যময় শব্দ শোনা যায়। থেকে থেকে উঁচু-নিচুতে পড়ে খাবি খেতে খেতে পথ চলতে হয় না। কেবল রাস্তায় একটু পর পরই টোল সেন্টার। এসব টোল সংগ্রহের জন্য আছে শয়ে শয়ে কর্মী। অধিকাংশই তরুনী। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম শুধু টোল সেন্টারে নয়, সমগ্র দেশের শপিংমল, টিকেট কাউন্টার, কাস্টমার সার্ভিস, পর্যটন প্রতিষ্ঠান, রেস্টুরেন্টে, রেলগাড়ীর ড্রাইভার, বিভিন্ন পর্যটন স্থানের গাইড, এয়ারপোর্টে, তথ্য কেন্দ্রে, সর্বত্র মেয়েরা কাজ করছে। ব্যাপারটা মাথায় নোট করে নিলাম।

পথে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় মনুমেন্ট ‘মোনাস’ চোখে পড়ল। ৪৪৯ ফুট উঁচু। আর গোড়া থেকে ৬০ ফুট উঁচুতে ৪৫ বর্গমিটারের এক প্লাটফর্ম। চুড়ায় বিশাল আকৃতির আগুনের শিখা সোনা দিয়ে মোড়ানো। শুনেছি শিখার এই অংশটুকু সোনা দিয়ে মোড়াতে ১৭ কেজি সোনা ব্যবহার করা হয়েছে। এই সকালের আলোয় সোনারঙ যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। ১৯৬২ সালে এই মনুমেন্টের কাজ হাতে নেন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ। ফ্রডেরিক সেলাবান এবং আর. এম. সুদর্শনো দুজনেই প্রেসিডেন্ট সুকর্ণর পরামর্শ মতো এই মনুমেন্টটি তৈরি করেছিলেন। গতকাল সন্ধ্যায় যখন এখানে এলাম তখন কোথাও কেউ নেই অবস্থা। ছবি তোলার চেষ্টা করেও ভালো কোন ছবি তুলতে পারিনি। জানলাম, বিকেল ৫টায় বন্ধ হয়ে গেছে। আজকে দেখলাম গরমের মধ্যেও প্রচুর ভিড়। ৩০-৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তো হবোই। চোখ মেলে পুরো মনুমেন্টটা ভালো করে দেখলে মনে হবে, এর শরীরে উচ্চকিত এক গর্ব মিশে আছে। ইন্দোনেশিয়ায় বহু বছর ডাচ উপনিবেশিক শাসন চলেছে। ১৯৫০ সালে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেন দেশের বীরযোদ্ধারা। উপনিবেশিক এই শোষনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বীরযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের স্মরণে এই মুনমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল। দীর্ঘ ৯ বছর পর ১৯৭১ সালে এটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এই মনুমেন্টের উপরের অবজারভেশন টাওয়ার থেকে জাকার্তা শহরের সবচেয়ে ভালো স্কাই লাইন দেখা যায়। সকাল আটটায় মনাসের গেট খুলে দেয়া হয়। জনপ্রতি টিকেট পাঁচ হাজার রুপি। বাংলাদেশি টাকায় ৩০ টাকার মতো। বিশাল লিফটে পর্যটকরা উপরে উঠছে ছবি তুলছে, নেমে আসছে। আমরা যদিও লম্বা লাইন দেখে সময়ের অভাবে উপরে উঠলাম না।

তামানমিনির গেট থেকে টিকেট কেটে সোজা ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

তামানমিনির প্রধান গেটের নাম কালামাকারা গেট। এই গেট পাড় হয়ে বা দিকে এগুলেই টিকেট কাউন্টার। প্রথমেই বিশাল সাইজের এক বিলবোর্ডে তামানমিনির ম্যাপ। এই ম্যাপ দেখে বন্ধু ‘আদে’র কথা খুব একটা মিথ্যা বলে মনে হলো না। এত কিছু দেখবো কখন! আমারা সামনে এগুতে থাকলাম।

বিশাল এলাকা। দর্শকের উপচে পড়া ভিড় না থাকলেও একেবারে খা খা অবস্থাও নয়। আজকে রোববার নয় বলেই রক্ষা। তবে রোববার প্রতিটি প্যাভিলিয়নে নাচ, গান, প্রতিযোগীতা কত কী আয়োজন হয়! দিনভর ঘুরে ঘুরে এগুলো দেখা বোঝা আর ছবি তোলার মজাই আলাদা। হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে পুরো এলাকটাকে পার্কের মতোও মনে হয়। সবুজ ঘাস, বাহারি গাছ, লতা পাতা, সাজানো পরিপাটি ল্যান্ডস্কেপ। এই বিশাল পার্কটির ঠিক মাঝখানে একটা বড় লেক আছে আর লেকটিকে সমুদ্রের সাথে কল্পনা করে তার মাঝখানে কৃত্রিমভাপে পুরো ইন্দোনেশিয়ার প্রধান দ্বীপগুলোকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অপূর্ব দেখতে। নৌকায় লেকে ভ্রমণ করতে পারেন, নামতে পারেন এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে।

পৃথিবীর নানাদেশের পর্যটকদের উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি। সামনে তাকিয়ে দেখলাম একটা তিনরাস্তার মোড়ের মতো স্থান। মোড়ের ঠিক মাঝখানে একটা বিশাল ফুল। আসলে এটা ফুল নয়, একটা ঘড়ি - ফ্লাওয়ার ক্লক। সাইনেজ দেখে আমরা হাতে বা দিকে মোড় নিলাম। পরপর বেশ কিছু জাদুঘর চোখে পড়ল। আমরা প্রথম জাদুঘরে ঢুকলাম। মূলত বেতার আর টিভি ব্রডকাস্টিং এর ওপর এই জাদুঘরটি নির্মিত। অনেক ধরণের মুভি ক্যামেরা দেখলাম এখানে। ভেতরে ইন্দোনেশিয়ার এ সংক্রান্ত বিখ্যাত ব্যাক্তিদের আবক্ষ মূর্তি। এই সাত সকালেও কোন স্কুলের কয়েকজন শিক্ষিকা একদল ছাত্রছাত্রী নিয়ে এসে পড়েছে। তারা লাইন ধরে কাচ ঘেরা বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখছে। এক জায়গায় দেখলাম বড়সড় জটলা এগিয়ে দেখি একটা ডকুমেন্টরি দেখানো হচ্ছে - সুনামির ওপর। মনে পড়ে গেলো, ২০০৪ সালের সুনামির কথা। ভারত মহাসাগরের এই সুনামি আঘাত হেনেছিলো ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে। দিনটি ছিলো ২৬ ডিসেম্বর, রোববার। প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিলো একদিনেই। আঘাত হানা ১৪টি দেশের প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষ গৃহহীন করেছিলো এই সুনামি। সবাই বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে সুনামির পর্বতসমান ঢেউয়ের ধেয়ে আসা দেখছে।

রাস্তার একপাশে মাথার ওপর দিয়ে মনোরেল লাইন চলে গেছে। চাইলে এই রেলে চেপে বসা যায়। পুরো পার্কটি ৪০ মিনিটে একবার চক্কর দিয়ে আসবে এই রেল। ব্যাস্ দেখা হয়ে গেলো। কিন্তু ভালো করে দেখতে চাইলে পায়ে হাঁটায় শ্রেষ্ঠ উপায়। এর একটু পরেই বাদিকে পড়লো স্নো বে ওয়াটার পার্ক। এর পরেই শুরু হয়েছে বিভিন্ন দ্বীপের প্যাভিলিয়ন। পাপুয়া, সুমাত্রা, নুসা তেংগারা, জাভা, কালিমান্তাং, বালি, তিমুর, সুলাওয়েসি ইত্যাদি দ্বীপরাজ্যের প্যাভিলিয়ন। মোট ৩২টি। প্যাভিলিয়নগুলো তৈরি করা হয়েছে তার নিজস্ব স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের আদলে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য।

এভাবে একের পর এক প্যাভিলিয়ন, মাঝখানে মাঝখানে নানা জাদুঘর দেখে চলেছি। জাতীয় জাদুঘর, যানবাহন জাদুঘর, সংস্কৃতি ও পর্যটন কেন্দ্র, পাখি জাদুঘর, তথ্য জাদুঘর এরকম গোটা বিশেক জাদুঘরতো আছেই। বেশিও হতে পারে। ঘণ্টা চারেক এভাবে ঘোরঘুরি করার পর যখন বুঝলাম এর আয়তন এত বিশাল যে সারাদিন ঘুরেও শেষ করা যাবে না, তখন রণে ভঙ্গ দিলাম এবং মনো রেলে চেপে বসলাম। বাকি অংশ না দেখে ফিরে যেতে মন চাইছে না।

উপর থেকে পার্কটা দারুণ নজরে আসে। অনেকে বাইসাইকেলে, অনেকে ট্যানডেমে (দুই, তিন, বা তারও বেশি সাইক্লিস্ট একজনের পেছনে আরেকজন বসে) দারুণ উপভোগ করছে এই তামানমিনি। ভারায় সাইকেল পাওয়া যায়। বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে চাইলে ট্রলিও ভাড়া পাওয়া যায়। এছাড়াও আছে দৃষ্টি-নন্দন বাস। আপনি যেমন খুশি চান ঘুরতে পারবেন।

দেখতে দেখতে শরীর ক্লান্ত হয়ে আসে কিন্তু চোখের সাধ মেটে না। এক সময় সন্ধ্যা হয়ে এলো। অনেক নোট নিলাম। ছবি তুললাম। শুধু আরাম করে খেতে পারলাম না। মুন্নার খাবারে গন্ধ শোঁকার বাতিক আছে। বিদেশে গিয়ে যাই-ই খায় আগে তার গন্ধ শোঁকে। সেই গন্ধ শুঁকে যদি তাকে হালাল এবং উপাদেয় মনেহয় তবেই মুখে তুলবে নইলে অনাহারেই তার আনন্দ। আমারতো দুভার্গ্যক্রমে এসব নেই। খেতে বড় ভালোবাসি। কিন্তু বাঙাল সন্তান একজনকে অভ’ক্ত রেখে সামনে বসে গপাগপ খাই কী করে! সুতরাং আমিও অনাহারে থাকি। মাঝখানে অবশ্য ভুজংভাজুং দিয়ে আজানা ফলে রস খাইয়েছিলাম। বললাম, এই জুস আমি চিনি, ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহ্যবাহী ফল সালাকের রস। খুবই সুস্বাদু এবং যেহেতু ফল সুতরাং একদম হালাল। আসলে কিসের জুস ছিলো কে জানে! ভয়ে জুসওয়ালাকে আর জিজ্ঞেস করারও সাহস পাইনি।

প্রত্যেকটি বাড়ি যেন ঐ দ্বীপ আর দ্বীপের অধিবাসীদের জীবন যাপনের অসাধারণ চিত্রায়ণ। সন্ধ্যা হয়ে এলো। আলো জ্বলে উঠলো চারপাশে। রাতে তামানমিনি জুড়ে দেখা যায় নয়নভিরাম আলোকসজ্জ্বা। যেন এই মিনিয়েচার ইন্দোনেশিয়া অন্ধকার মহাকাশে জ্বলন্ত নক্ষত্রবিথীকার মতো উদ্ভাসিত হয়ে ওঠলো। আমার ক্লান্ত দেহে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে বসে আছি। উন্মুক্ত স্থানে অনেক চেয়ার পাতা। দুই প্লেট খারারের অর্ডার দিয়েছি। মুন্না অনেকক্ষণ ধরে এই খাবারের গন্ধ শুঁকে চলেছে।
ওয়েটারকে বারবার প্রশ্নটা বোঝানোর চেষ্টা করছে, “এটা হালল কিনা জিজ্ঞেস করে আমি যে তোমাকে প্রশ্নটা করলাম সেটা তুমি সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছ?”।
ওয়েটার উপরে-নিচে মাথা নাড়লো।
মুন্নার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ও কী আসলেই বুঝতে পেরেছে?’
আমি বললাম, নিশ্চয়ই বুঝেছে।
‘তাহলে উত্তর দিচ্ছে না কেন?’
উত্তর তো দিতে বলিসনি। শুধু জিজ্ঞেস করেছিস প্রশ্ন বুঝেছে কিনা। তার উত্তর তো দিয়েছে।
মুন্না আবার ওয়েটারের দিকে তাকালো এবং বলল, ‘উত্তর দাও।’
ওয়েটারের বিস্মিত প্রশ্ন, ‘কিসের উত্তর?’
মুন্না নাছোড়বান্দা এবং একটু উত্তপ্ত, “ইজ ইট হালাল?”
“ইয়েস, হালাল।”
“ইজ ইট পর্ক অর বিফ?“
“মাটন।”
“দেন হোয়াই দিস কাইন্ড অফ স্মেল?”
“মাসালা স্মেল, গুড স্মেল।”

মুন্না আমার দিকে তাকালো, আমার ততক্ষণে খাওয়া শেষ।
মুন্না ক্ষিপ্ত গলায় বলল, “এই ব্যাটা গুল মারছে। মসলার গন্ধ আমারে শিখায়।”
আমি বললাম, “তুই বরং খাইস না। আসলেই কেমন কেমন যেন লাগছে।”
মুন্না খাবার ঠেলে সরিয়ে দিলো।
আমি কাল বিলম্ব না করে, খাবারের প্লেটটা টেনে নিলাম এবং মুন্নার বিস্ফোরিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে সুস্বাদু খাবারের পুরো প্লেটাটা সাবার করে দিলাম।

হোটেলে এসে গরম পানি দিয়ে আরম করে গোসল করলাম। মনে হলো সারাদিনের ক্লান্তি শেষ। মুন্না বলল, চল্, রাতের জাকার্তা দেখতে বের হই। উত্তম প্রস্তাব। রেডি হয়ে চললাম আবার। কিন্তু জালান জাকসা রোডের আয়োজন দেখে আমরা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে টুল পেতে বসলাম। সামনে গোলমতো একটা টেবিল। এই রকম রেস্টুরেন্ট আসে পাশের সমস্ত রাস্তায়। হয়ত ব্যস্ত এলাকার সমস্ত রাস্তাই এখন ভোজন রসিকদের দখলে। খোলা রেস্টুরেন্টে চলছে নানারকমের খাবারের আয়োজন। গায়কদল গান বাজিয়ে বাজিমাত করে দিচ্ছে। খুব যে খারাপ বাজাচ্ছে তা নয়। তবে খুব সংক্ষেপ। একটু বাজিয়েই মাথার হ্যাট খুলে সামনে ধরছে, যে যা পারছে তুলে দিচ্ছে হ্যাটের মধ্যে। এই-ই তাদের আয়। তারপর হাসি মুখে চলে যাচ্ছে পরের রেস্টুরেন্টে। হয়ত কিছুক্ষণ বিরতি। আবার অন্য কোন গানের দল বা একক কোন বাদক এসে দাঁড়াচ্ছে রেস্টুরেন্টগুলোর সামনে। বাজনা বাজছে। সবাই এই ধরনের আয়কে ভিক্ষা করা বলে। আমার মুখে বাঁধে। আমি একে ভিক্ষা বলতে পারি না। মুন্না খুব আরাম করে রুটি আর ডিম ভাজি খাচ্ছে। বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলাম, বলতে যাচ্ছিলাম, দেখলে মুরগীর মতো হলে কি হবে এই ডিম কমোডো আয়ল্যান্ডের ড্রাগনের ডিম।”

রাত বেড়ে চলছে। সোডিয়াম লাইটের নীচে ঘনাচ্ছে অন্ধকার। আমরা শহরের রাস্তা ধরে হাঁটছি। কেউ কেউ ডিনার শেষ করে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। রাত দশটার দিকে আমরা ডিনার করবো বলে জালান জাকসা থেকে কিছু দূরের একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম।

সিরাজভাইসহ বাংলাদেশের আরো বেশ কয়েকজন একসাথে ডিনার করবো বলে আগেই ঠিক করে রাখা ছিলো। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই একটা ধাক্কা খেলাম। খাবার পরিবেশনকারীরা সবাই মেয়ে। সাধারণত হোটেল বা রেস্টুরেন্টে সার্ভিস দিতে পুরুষদেরকেই দেখে অভ্যস্ত, বিশেষকরে মুসলিম দেশে। এই রেস্টুরেন্টের কেশিয়ার পর্যন্ত মহিলা। রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই আমাদের বসার জন্য ব্যবস্থা করা হলো বড়সর এক টেবিলে। সার্ভ করা হলো জিরার শরবত। জলজিরা বা জিরার শরবত কোলকাতায় বা ঢাকায়ও আগে খেয়েছি কিন্তু বরফকুচি দেয়া এ শরবতের অন্যরকম স্বাদ।.

জাকার্তার খাবারের বিশেষত্ব হলো এর মসলার ব্যবহার আর পরিবেশনের পরিচ্ছনতা। খাবারের সাথে পাপড় থাকবেই। স্টার্টার বা খাবার মাঝখানেও পাপড় খাওয়ার চল দেখলাম সর্বত্র। রাতের খাবারে অনেকেই কাবাব পরোটা খান। তবে এখানে কাবাব গরুর মাংস দিয়ে হয় না বললেই চলে। হয় মুরগীর মাংস দিয়ে। এই মুরগীর কাবাবকে বলা হয় সাথী। ইন্দোনেশিয়ার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক খাবারের নাম ‘নাসি গোরেং’। ফ্রাইড রাইস জাতীয় খাবার, সাথে ডিমের অমলেট, আরো কিছু অনুষঙ্গ আছে সাথে। আর বাই ডিফল্ট সেই পাপড়তো থাকবেই।

ডিনার শেষে সবাই মিলে হাঁটলাম আরো অনেকটা পথ। প্রায় মাঝরাত হয়ে এলো। এক সময় ক্লান্ত হয়ে ফিরলাম হোটেলে। ততক্ষণে জালান জাকসা রোডেও নিরবতা নেমে এসেছে।

(জাকার্তায় কয়েকদিন - শেষ পর্বে পড়ুন: জাকার্তার বইয়ের বাজার, রাগুনান চিড়িয়াখানা, সুরাবায়ার পাখি আর ফুলের বাজারসহ আরো অনেককিছু।)


Comments

দীনহিন's picture

Quote:
বাংলাদেশ থেকে যে-টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম তাতে ইন্দোনেশিয়া গিয়ে নিজেদেরকে প্রায় কোটিপতি ভাবতে শুরু করলাম।

আর কিছু হই বা না হই, ইন্দোনেশিয়া যেয়ে একবার কোটিপতি হওয়ার স্বাদ গ্রহন করতে চাই। হাসি

ভ্রমনকাহিনি আমার বরাবর প্রিয়, আপনি কষ্ট করে আপনার দেখা আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন, সে জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ভাই।

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

সৈয়দ আখতারুজ্জামান's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

মেঘলা মানুষ's picture

Quote:
শেষ পর্বে পড়ুন: জাকার্তার বইয়ের বাজার, রাগুনান চিড়িয়াখানা, সুরাবায়ার পাখি আর ফুলের বাজারসহ আরো অনেককিছু।

পরের পর্বের জন্য আগ্রহ বাড়িয়ে দিলেন।

সৈয়দ আখতারুজ্জামান's picture

আসছে শীঘ্রই। অনেক ধন্যবাদ।

তিথীডোর's picture

ছবিগুলোর সাইজ ঠিক করে দিন দয়া করে, প্রস্থে নীড়পাতা ছাড়িয়ে এবং ছাপিয়ে যাচ্ছে।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সৈয়দ আখতারুজ্জামান's picture

আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্ত ঘটনারতো কোন পরিবর্তন দেখি না।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ's picture

আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে!!!

নীড়পাতায় প্রথম ছবিটা ডানদিকে বের হয়ে গেছে। থিক করে দেয়া যায়?

____________________________

সৈয়দ আখতারুজ্জামান's picture

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমারও লেখা আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে প্রোফেসর হিজিবিজবিজ। ছবি ঠিক করার জন‌্য চেষ্টা করছি, সাহায্য পেলে ভালো হতো।

সৈয়দ আখতারুজ্জামান's picture

আশাকরি সমাধান হয়েছে এখন। সমস্যার কথা জানানোর জন্য তিথীডোর আর প্রোফেসর হিজিবিজবিজকে ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করতে চাই না।

এক লহমা's picture

ভাল লাগল।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সৈয়দ আখতারুজ্জামান's picture

‌আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.