ফিরে দেখা আমাদের গ্রামখানি(১) - প্রাকৃতিক আবহ

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture
Submitted by aam [Guest] on Sat, 19/04/2014 - 8:02pm
Categories:

মোটামুটি জ্ঞান বুদ্ধি হওয়ার পর ষাটের দশকের শেষাংশ থেকে দীর্ঘ চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে দেখে আসছি আমাদের গ্রামটিকে। এই সময়কালে গ্রামটির প্রাকৃতিক ও ভৌত কাঠামোয় কিছু পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু আমুল পরিবর্তন এসেছে এ গ্রামের অধিবাসীদের যাপিত জীবনে। আবহমান কাল থেকে চলে আসা রীতিনীতি, নিয়মকানুন, কর্মপদ্ধতি, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, প্রযুক্তি, সর্বোপরি মানুষের জীবনাচরণে এসেছে দৃশ্যমান ব্যাপক পরিবর্তন। পিছু ফিরে দেখলে ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না যে এভাবে বদলে গেছে এ গ্রামের এতকিছু। শত শত, কিংবা হাজার বছর ধরে যা ছিল প্রায় অপরিবর্তনীয়, কালের এই ক্ষুদ্র পরিসরে তার আমুল পরিবর্তন ঘটলো আমারই চোখের সামনে। এক অর্থে এ আমার পরম সৌভাগ্য যে আমি এ পরিবর্তনের সাক্ষী, তবে এতে প্রাপ্তির আনন্দ যেমন আছে, হারাবার বেদনাও আছে অপরিসীম।

বাংলাদেশে কোন একটি গ্রাম থাকবে, আর সে গ্রামে একটি নদী থাকবে না, তা তো আর হতে পারে না। সুতরাং আমাদের গ্রামকে দক্ষিন ও পশ্চিম দিকে বেষ্টন করে প্রবাহিত হতো একটি নদী, ছোট একটি নদী। ক্লাস টু বা থ্রি'তে আমাদের পাঠ্য ছিল রবীন্দ্রনাথের "আমাদের ছোট নদী" কবিতাটি, তখন আমার ধারনা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামক একজন হিন্দু ঋষি আমদের গ্রামের নদীটি দেখেই কবিতাটি লিখেছেন। শুকনো মৌসুম এবং বর্ষায় নদীটির আকৃতি প্রকৃতিতে ছিল আকাশ পাতাল প্রভেদ। কার্ত্তিক থেকে বৈশাখ অবধি নদীতে খাঁড়ি বা বাঁক বা দহ গুলো ছাড়া অন্য সব অংশে হাঁটু পানি বিরাজ করতো। সেই হাঁটু পানিতেই গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন নানা কাজ, যেমন- মানুষ ও গবাদি পশুর স্নান, বাড়ীর নিত্য ব্যবহার্য পানি আহরণ, সেঁচের কাজ ইত্যাদি চলতো। জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে নদীর রুপ বদলাতে থাকতো, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকতো পানি। আষাঢ় মাসেই নদী ভরে গিয়ে দু পারের ফসলের মাঠে পানি ঢুকত, প্লাবিত হতো মাঠ, ঘাট, রাস্তা সবকিছু। শুধু বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত জেগে থাকতো গ্রামের পাড়াগুলো। বর্ষায় নদীতে নৌকা চলতো বেশুমার, ছোটবড়, পাল তোলা, গুণ টানা, দাঁড় টানা, পানসি, গয়না, বজরা, ডিঙ্গি কত কিসিমের যে নৌকা। স্থানে স্থানে জেলেদের খরা জাল পাতা থাকতো। গ্রামের সর্বসাধারণও নানা রকম জালে প্রচুর মাছ মারতো। ভরা বরষায় মুহুর্মুহু ভুস করে ভেসে উঠত মিঠে পানির ডলফিন- শুশুক। নদীর দু'পারে এখানে সেখানে ছোটবড় অসংখ্য কাছিম রোদ পোয়াতে বসে থাকতো। একবার গ্রামের বাড়ীতে গিয়ে মনে প্রশ্ন জাগলো আচ্ছা, এ নদীটির নাম কি? জনে জনে শুধাতে লাগলাম এই প্রশ্ন। আশ্চর্য, কেউই জানে না তার নাম। নদীটির উৎপত্তি স্থানের বিষয়েও কারো কোন ধারনা নেই। অনেক পরে গুগল আর্থের কল্যাণে জেনেছি এর উৎপত্তি করতোয়ায়, সমাপ্তি বড়ালে। উনবিংশ শতাব্দীর জেলা গেজেটে এর নাম করতোয়া খাল, যদিও শেষ পর্যন্ত এক প্রবীন আমাকে নদীটির নাম বলেছিলেন- সোনাখালী। সোনাখালী নামটি আমার দারুন পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু গ্রামের প্রায় কেউই কেন নদীটির নাম জানে না, এ নিয়ে খুব মনক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। সুদূর অতীত কাল থেকে যে নদীটি এ তল্লাটের মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে প্রবাহিত হয়ে এসেছে, সে কি এতই তুচ্ছ যে তার নামটিও কারো জানার প্রয়োজন পরে নি?
নদী ছাড়া আর ছিল দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, একটি বিল, ছোট ছোট কয়েকটি বন, আর একটি মেটে সড়ক। সড়কটি বছরের অর্ধেক সময় পানির নিচেই থাকতো, শুকনো মৌসুমে হাঁটা এবং গাড়ীর(বলাই বাহুল্য গরুর গাড়ী) পথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মাঠে ধান ফলতো অনেক জাতের, বর্ষার শেষে আমন কেটে চৈতালি ফসল, তার পর আউশ কিংবা পাট। বিলটি বর্ষায় নদী এবং মাঠের পানির সঙ্গে একাকার হয়ে যেত, বর্ষার পানি নেমে গেলে বিলের আবদ্ধ পানি হরেক রকম মাছের উৎস হয়ে থাকতো। বর্ষা ও শীতে সেখানে মেলা বসতো দেশী বা পরিযায়ী নানান জাতের পাখীর। জলজ নানা ফল যেমন- শালুক, ঢ্যাপ, পদ্মচাক ইত্যাদির অফুরন্ত ভাণ্ডারও ছিল সেই বিল। ছোট বনগুলো বোধ হয় সরকারী খাস জমি, নয়তো উজার হয়ে যাওয়া কোন বসত ভিটা ছিল। নানান জংলা গাছ, আর শিয়াল, বনবিড়াল, খাটাশ, বেজী, সাপ, গুইসাপ, বন্য পাখীদের আবাসভূমি ছিল সেসব বন।
বসত বাড়ীগুলো ঘিরে থাকতো নানা গাছগাছালি, বিশেষ করে বাড়ীর পিছন দিকে বাঁশ ঝাড় ছিল সাধারন বিষয়, বেতের ঝাড়ও অনেক বাড়ীতেই ছিল। দেশী ফলের গাছ কমবেশি সব বাড়ীতেই ছিল। আম কাঁঠাল ছাড়া অন্য ফল কিনে খাওয়ার চল খুব একটা ছিল না। প্রায় বাড়ীতেই লাগোয়া পলানে শাক সব্জির আবাদ হতো, বানিজ্যিক ভিত্তিতে শাক সব্জি চাষ হতো না।

বর্তমান অবস্থাঃ নদীটি এখন প্রায় মৃত। বহু শত কিংবা হাজার বছর ধরে যে নদীটি ছিল অত্র এলাকার জীবনধারা, সভ্য হওয়ার পর মানুষ সেই নদীটিকে এখন হত্যা করছে। করতোয়ায় যেখানে নদীটির উৎপত্তি, সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি স্লুইস গেট বানিয়েছে, কেন কে জানে। শুকনো মৌসুমে এখন হাঁটু জল তো দুরস্ত, ক্ষেত্রবিশেষে নদীর অনেক অংশে কোন পানিই থাকে না, সেই শুকনো নদীখাতে গরু বা গাড়ী কিছুই আর পার হয় না। নদীর বুক চিরে অনেক স্থানেই এখন এটা সেটা আবাদ হয়। বর্ষা কখন আসে আর কখন যায়, সেভাবে আর বোঝা যায় না। ছোটবেলায় আমাদের মত শহুরে প্রবাসীরা তো বটেই, গ্রামেরও সকল ছেলেমেয়ে মুখিয়ে থাকতো কখন নদীতে যাবে নাইতে। দাপাদাপি, লাফালাফি আর সাঁতারে কয়েক ঘণ্টা কেটে যেত নদীতেই। খুবই অবাক করা ব্যাপার হল বড়রা তো বটেই, গ্রামের ছোটরাও এখন আর কেউ তেমন একটা নদীতে গোসলে আগ্রহী নয়। আমাদের জ্ঞাতি গোষ্ঠীর ছেলেপেলেদের এর কারন জিজ্ঞেস করে যা জেনেছি, তা হল- নদীর পানি নাকি ময়লা। অন্য নৌকার তো প্রশ্নই নাই, খেয়া নৌকাগুলোও উঠে গেছে। কারন গ্রামের দু-প্রান্তে নদীর উপর দুটি পাকা সেতু হয়েছে, খেয়া নৌকায় কে আর উঠবে। সেই মেটে সড়কটি এখন চওড়া আর পাকা হয়েছে, সারা বছরভর সে রাস্তায় রিক্সা, মটর সাইকেল, ইজি বাইক, সিএনজি, নসিমন, আর মাঝে সাঝে প্রাইভেট গাড়ীও চলাচল করে। আগে গ্রামের রাস্তায় অচেনা কাউকে দেখা গেলে অতি অবশ্যই- সে কোথা থেকে এসেছে, কোথায়ই বা যাচ্ছে, এসব জিজ্ঞেস করা হতো, এখন জনভারে সে চল উঠে গেছে।
বিলটি এখন আর নেই, পুরোটাই কৃষি জমিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। সুতরাং বিলুপ্ত হয়ে গেছে বিলের যাবতীয় মাছ, জলজ ফল এবং জলজ পাখী। নিম্নবঙ্গের একটি গ্রাম হিসেবে এ এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন। আবহমান কাল থেকে যে গ্রামের মানুষ বিলের নানা বিষয়ের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ছিল, মাত্র ত্রিশ চল্লিশ বছরের মধ্যে ভোজবাজীর মত সে সবের কোন কিছুই আর নেই, এমনকি খোদ বিলটিই নেই, কি তামাশা! ছোট বনগুলিও আর নেই, হয় চাষের জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে, নয়তো বসতবাড়ীতে। সুতরাং সে সব বনের অধিবাসী জীবজন্তু আর পাখীকুল কোথায় হারিয়ে গেছে। এ গ্রামের পত্তনের সময় থেকে যে প্রাণীগুলো ছিল গ্রামের মানুষগুলোর নিত্যসঙ্গী, কোন দুষ্ট দানবের জাদুর অভিশাপে সে সবই আজ চিরতরে চলে গেছে কালের গর্ভে। শিয়াল আর বনবেড়ালের উৎপাতে নাকাল গ্রামবাসী কখনো কখনো হয়তো তাদের বিনাশ কামনা করতো। এখন শেয়ালকূলের অবলুপ্তিতে হাঁসমুরগির জীবন হয়তো সুরক্ষিত হয়েছে, কিন্তু রাতের প্রহরে প্রহরে শেয়ালের হুক্কাহুয়া রব শোনার যে আকুতি তাদের মন প্রাণকে উদাস করে তোলে, সে আকুতি তো আর কখনই পূরণ হবে না।


Comments

প্রৌঢ় ভাবনা's picture

আপনায় লেখায় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের বাস্তব চিত্রটিই ফুটে উঠেছে। আমি বিগত প্রায় চল্লিশ বৎসর ধরে নিয়মিত গ্রামে যাতায়াত করছি। আপনি যেভাবে লিখেছেন সে রকম পরিবর্তনটাই আমার চোখেও পড়েছে। কোথায় হারিয়ে গেল সেই চিরচেনা গ্রাম আর গ্রামের মানুষের আতিথেয়তা!
ভাল থাকুন। আনন্দে থাকুন।

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

শাহীন হাসান's picture

বহু শত কিংবা হাজার বছর ধরে যে নদীটি ছিল অত্র এলাকার জীবনধারা, সভ্য হওয়ার পর মানুষ সেই নদীটিকে এখন হত্যা করছে।
কোন কোন কবি আছে, নদীকে ভালবাসলে সে নদীও মরে যায় ।। যেমন নড়াইলের চিত্রা, মধু কবির, কপোতাক্ষ নদ।।।
লেখাটি মন খারাপ করে দিয়েছে ।।

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture

মন ভাল হওয়ারও কিছু ব্যাপার কিন্তু আছে।

মন মাঝি's picture

চলুক

****************************************

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ's picture

চলুক

____________________________

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক's picture

মন খারাপ

স্মৃতি বিষন্নতায় কিছুক্ষন দগ্ধ হলাম লেখাটি পড়ে। আমি গত দুই যুগের কথা বলতে পারবো, দুই যুগের মাঝে যে পরিবর্তট ঘটেছে তাই বিস্ময়কর মনে হয় এখন। শুধু ছোট্ট একটা উদাহারণ দেই, আমার গ্রামের বাড়ির পেছনের অংশটা ছিলো জঙ্গলাকৃতির। সেই পথে হাঁটতে গেলেই দেখা পেতাম অসংখ্য গুই সাপের, এমনকি একবার পুকুরে জাল টেনে ভাবলাম ইয়া বড় মাছ পড়েছে জালে, জলের নিচ থেকে উপরে তুলে দেখি গুইসাপ। আর এখন আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজে ও একটা গুইসাপ দেখিনি আমার বাড়িতে গত ৪-৫ বছরে! কোথায় হারিয়ে গেল শৈশবের সেই গুইসাপ? সবকিছুকে এভাবেই হারানোর খাতায় যোগ হবে শুধু?

মাসুদ সজীব

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture

অনেক কিছু হারানোর বিপরীতে কিছু প্রাপ্তিও আছে। তবে ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে যাওয়া বড়ই কষ্টের।

তাহসিন রেজা's picture

আমাদের নদী গুলোর কি করুণ মৃত্যু হচ্ছে মন খারাপ

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture

মন খারাপ

হাসিব's picture

ইয়ে, শব্দটা ভৌত কাঠামো, ভৌতিক কাঠামো নয় হাসি
বাংলাদেশে জৈববিচিত্রতা (শব্দটাতো এটাই, তাই না?) নষ্ট হয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুতগতিতে। অব্যাহত নগরায়ণে গ্রাম বলতে কিছু থাকবে না আর বছর বিশেকের মধ্যে।

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture

আরে তাইতো! শুধরে দিলাম, ধন্যবাদ!

এক লহমা's picture

চমৎকার লেখা। কী আশ্চর্য না, নদীর তীর ধরেই সভ্যতার জন্ম, আর নদীকে হত্যা করেই তার প্রসার চলছে!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture

হ্যাঁ, আশ্চর্যই বটে!

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.