চক্র চিরন্তন

মৌনকুহর's picture
Submitted by mounokuhor [Guest] on Mon, 03/12/2012 - 8:47am
Categories:

“নজরুল-শরৎচন্দ্রের কোনো দরকার নাই তো আমার! ক্লাস ফাইভের অঙ্ক পরীক্ষায় সতের পেয়ে ফেল মারেন, তারপর আবার পড়া ফেলে ‘সাহিত্যচর্চা’?! লজ্জা করে না?! বেশরম! বেহায়া! যাহ্!”

খাতাটা ছুড়ে মারলেন বাবা, দশ-বারো হাত দূরে। তুলে আনার আর সাহস পেলাম না।

সে-ই হয়তো শেষ হত। কিন্তু জাতীয় দৈনিকের ছোটদের পাতায় জীবনের প্রথম লেখাটাই যার ছাপা হয়ে যায় দৈবক্রমে, সে কি আর অত সহজে বিসর্জন দিতে পারে মস্ত বড় লেখক হবার স্বপ্ন! পারি নি। লিখতাম। চুপি চুপি পোস্টও করতাম। কোথাও অবশ্য ছাপা হত না সেসব ছাইপাঁশ।

দেখতে দেখতে দিন কেটে যায়। প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা রাখি। বেড়ে যায় পড়াশুনার চাপ। এইটের ব্যস্ততা, এরপর এসএসসি, তারপর এইচএসসি— একটা সময় টেক্সটবুকেই ‘বুক্ড’ হয়ে গেলাম আমি। ‘অবসর’ বলতে আর রইল না কিছু। থমকে গেল ‘সাহিত্যচর্চা’।

বছরখানেক বাদে। স্কুল-কলেজ পেরিয়ে ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায়। প্রথম সেমিস্টার শেষ। মাস দুয়েকের ল—ম্বা ছুটি। অনেক দিন পর অমন ছুটির দিনে পুরনো সেই শখের হঠাৎ পুনর্জন্ম হল। ভাবলাম একটা কিছু লিখি। লিখলাম। কিন্তু পত্রিকায় পোস্ট করার আগে মনে হল, ব্যাটারা ছাপায় কি না ছাপায়— তার চেয়ে বরং কোন ব্লগে পোস্ট করে দিই। ভেবে-চিন্তে একটা ‘নিক’ ঠিক করলাম। তারপর দিলাম পোস্ট করে। বেশ ক’টা মন্তব্য পড়ল আনকোরা এক ব্লগারের প্রথম সেই পোস্টে। ভদ্রতার খাতিরেই হোক, কিংবা মন থেকে— লোকে বেশ প্রশংসা করল সেটির। বেশ অনুপ্রাণিত হলাম। নতুন উদ্যমে ফের শুরু হল আমার লেখালেখি। চলতে থাকলো সমান তালে।

ছোট্টবেলার ওই ‘খতরনাক’ ঘটনার পর বাবার সাথে লেখালেখি সম্পর্কিত কথা আর বলি নি কোনোদিন। বাবা বন্ধুসুলভ ছিলেন, সম্পর্কটাও সহজই ছিল, কিন্তু কেন যেন এই একটা ব্যাপারে ঠিক স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম না আমি। ব্লগিংয়ের ব্যাপারটাও তাই বলা হয় নি কখনও।

দিন কয়েক আগে। বাবার হঠাৎ খুব শরীর খারাপ। আমাকে ডেকে বললেন, তাঁর ল্যাপটপ থেকে অফিসের ইমেইলটা একটু চেক করতে। অফিসে যাবেন না, কিন্তু হাতে জরুরি ডিল। “আচ্ছা, বাবা” বলে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। ফায়ারফক্স ওপেন করে বুকমার্কসে গেলাম। খুঁজছিলাম জিমেইল ইনবক্স। কিন্তু টাসকি খেয়ে গেলাম নিচ থেকে দ্বিতীয় বুকমার্কটা দেখে— “মৌনকুহর এর বাংলা ব্লগ!” বাবা এই লিঙ্ক পেলেন কেমন করে!

আধো ঘুম, আধো জাগরণ— আরাম কেদারায় বসে আরাম করছিলেন তিনি। পুত্রের গগনবিদারী আবেগী হুঙ্কারে তড়াক করে উঠে বসলেন।
—কি রে! আগুন? না কি ভূমিকম্প?!
—দুটোই। তুমি আমার নিক জানলে কেমন করে, বলো তো!

বাবা লাজুক হাসি হাসেন। যেন ছোট্ট এক শিশু, রাস্তার খোলা আচার খেতে গিয়ে মায়ের হাতে ধরা পড়ে গেছে। মৃদু স্বরে বললেন,
“কেন, তুই টুইট করেছিলি না একবার?”

এইবার আমার আকাশ থেকে পড়ার পালা! এই ভদ্রলোক না সারা জীবন যাবতীয় নেটওয়ার্কিং সাইটকে কেবল ‘শ্রমঘণ্টার নিদারুণ অপচয়’ হিসেবে দেখে এসেছেন! পিসিতে ফেবু-টুইটার চালাতে দেখলেই এই মানুষটাই না কানমলা দিয়ে পড়ার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন!
“বাবা তুমি টুইটার চালাও! আমাকে ফলোও করো! কী নিকে?”
বাবা না শোনার ভান করেন। চোখ দুটো বুজে ফের গা এলিয়ে দেন। তারপর আস্তে করে বলেন,
“তোর হাত কিন্তু ভালোই রে। ধরে রাখিস। যে যা-ই বলুক, জীবনে আসলে কাজে লাগে এই সৃজনশীলতাটুকুই......”

সাড়ে সাত বছর আগের সেই সন্ধ্যায়, পড়ার টেবিলের পাশে বাবার ওই রুদ্রমূর্তিটা কেন যেন ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। সেই তিনি, আর এই তিনি। আমি মেলাতে চেষ্টা করি। পারি না। বয়েস বাড়লে এমন বদলে যায় কেন মানুষ? এত এত যে শৌর্য-বীর্য তা হঠাৎ কীসের ফুঁৎকারে উবে যায় অমন করে? চলনে-বলনে এমন স্থবিরতা এনে ভর করায় কোন সে অপ্রতিরোধ্য অপশক্তি?

কোনো জবাব খুঁজে পাই না আমি। চোখের কোণায় হঠাৎ জমা হওয়া নোনা এক ফোঁটা জল, যেন জানান দিয়ে যায়, বাবা বুড়িয়ে যাচ্ছে। বাবা বুড়িয়ে যাচ্ছে।


Comments

নীল আকাশ's picture

বাবারা এমনই। আপনার বাবার জন্য শুভ কামনা। চলুক

মৌনকুহর's picture

হুম্ম... হাসি
পাঠ ও মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

অতিথি লেখক's picture

বাবাগুলো মনে হয় এরকমই হয়। দারুণ লেখা ভাই। ছুঁয়ে গেলো।

ফারাসাত

মৌনকুহর's picture

ধন্যবাদ, ভাই ফারাসাত।

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

ধুসর জলছবি's picture

লেখাটা পড়ে ভাল লাগল খুব, সাথে আমার খুব মন খারাপও হল। ছোটবেলা থেকেই আমার যাবতীয় কাজের উৎসাহদাতা আমার বাবা । লেখালেখি আমি কখনই করিনি শুধু ডাইরি লেখা ছাড়া। লিখতে শুরু করার পর থেকেই আমি বানান করে করে ডাইরি লিখতাম, এবং যথারীতি সেই কাজেও বাবার উৎসাহ পেতাম। এখন মাঝে মাঝে যা মনে আসে লিখি অথচ সেটা পড়ার জন্য সে আর নেই কোথাও। লিখতে বসলেই হটাত হটাত এটা মনে পড়ে যায় আমার,কিছু করার থাকে না তখন, কিছু কিছু শূন্যতা তো আর কখনই পূরণ করা যায় না। তাই মন খারাপ করে থাকি, একসময় মন খারাপ করে থাকব এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যাই।
ভাল থাকুন, আরও লিখুন।

মৌনকুহর's picture

"হায়, জীবন এত ছোট কেনে? এ ভুবনে?" মন খারাপ

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

স্যাম's picture

অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম, ভাল লাগল।

মৌনকুহর's picture

ধন্যবাদ, স্যাম ভাই! হাসি

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

তানিম এহসান's picture

ওয়েল্কাম ব্যাক গুটলু দেঁতো হাসি

মৌনকুহর's picture

হিহিহি... থেঙ্ক্যু, মামা...!! দেঁতো হাসি

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

কৌস্তুভ's picture

বাহ বেশ বেশ, উচিত জব্দ হয়েছেন দেঁতো হাসি

মৌনকুহর's picture

কারও সব্বনাশ... আর কারুর পৌষ মাস! ইয়ে, মানে...

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

রংতুলি's picture

বাবা ছেলের সম্পর্কটাই বোধহয় এমন, দু' তরফ থেকেই কেন জানি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হতে দেয়া হয় না, তারপরেও কোথায় যেন একটা তীব্র অটুট বন্ধন থেকে যায়... হাসি

মৌনকুহর's picture

কথা ঠিক! হাসি

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

ব্যাঙের ছাতা's picture

হাসি বাহ!

মৌনকুহর's picture

হাসি আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

Abu Sufian Shakil's picture

আপনার হাত কিন্তু ভালই রে ভাই! ধরে রাখেন। যে যাই বলুক, জীবনে আসলে কাজে লাগে এই সৃজনশীলতাটুকুই হাসি

মৌনকুহর's picture

লইজ্জা লাগে আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

প্রৌঢ় ভাবনা's picture

সত্যিই কি বাবাদের এমনই হতে হয় ? তাহলে আমাকেও তো..........
লেখা ভাল লেগেছে।

মৌনকুহর's picture

পাঠ ও মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ, প্রৌঢ় ভাবনা হাসি

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

আশালতা's picture

ও বাবা, আপ্নে পত্রিকায় লেখা ছাপানো মানুষ নাকি! বাসরে, সাবধানে থাকতে হয় তাইলে। হাসি

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

মৌনকুহর's picture

এই সেরেছে! এক্কেবারে জায়গামতন তো দিলেন খোঁচাটা ওঁয়া ওঁয়া
আছেন কেমন? হাসি

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

মৃত্যুময় ঈষৎ's picture

কী বোর্ড চলুক চলুক

কেমন আছেন?


_____________________
Give Her Freedom!

মৌনকুহর's picture

ধন্যবাদ, মৃত্যুময় ঈষৎ ভাই! আছি বেশ। আপনি? হাসি

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

মৃত্যুময় ঈষৎ's picture

জীবনটা ইদানিং কিছুটা সরলরৈখিক, একটু বক্রতা দরকার!! হাসি


_____________________
Give Her Freedom!

মৌনকুহর's picture

সুখে থাকলে ভুতে কিলায়, নাকি?! চাল্লু

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

কড়িকাঠুরে's picture

হুম... হাসি

মৌনকুহর's picture

হুম্ম... হাসি

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

তারেক অণু's picture

খুব খুব ভাল লাগল, আপনার বাবার জন্য শুভেচ্ছা।

আমার বাবা মনে হয় আমার কোন লেখা পড়ে যেতে পারেন নি।

মৌনকুহর's picture

ধন্যবাদ, অণু ভাই!
কিছু কষ্টের কোনও উপশম নেই... মন খারাপ

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

সুলতানা পারভীন শিমুল's picture

ভীষণ মিষ্টি লাগলো আপনাদের বাপ-বেটার কান্ডকীর্তি। দেঁতো হাসি
বাপজান বুড়িয়ে যাচ্ছে, এই অনুভূতিটা আমাকেও মাঝে মাঝে পেয়ে বসে খুব। মন খারাপ

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মৌনকুহর's picture

"বাপজান বুড়িয়ে যাচ্ছে......" মন খারাপ

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.