"হারিয়ে গেছি আমি"

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২০/০৪/২০১৯ - ১২:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছোট ছেলে নাছোরবান্দা । মায়ের প্রথমে কড়া নির্দেশ, পরে আকুতি। মা আকুতি নিয়ে বলছেন, "তোমার পরীক্ষা চলছে। পহেলা বৈশাখের দিন শুধু ছুটি। তবু নিশ্চয় ওই দিন আমরা রমনায় যাব, চারুকলায় যাব । তাই ঘর সাজানোর জন্য আর সময় নষ্ট কোরো না । আমরাতো ঐদিন বাইরেই থাকব, ঘর সাজানোর আর দরকার কি।" ছেলে মোটেই নরম হয় না। সাজাতে তাকে হবেই। অন্তত দরজার গায়ে কিছু একটা। যেন এইটুকু বলা ‘স্বাগত হে নববর্ষ’ ।এভাবেই প্রতি উৎসবে চলে তার এই সৃজনসীল কর্মযজ্ঞ। মা মনে মনে হাসলেন, বাইরের কঠিনতা বজায় রেখে ।

মা ভাবেন তার ছেলেবেলার উৎসবের কথা । চিত্রটা বিপরীতই ছিল বটে। তাদের ভাইবোনের এমন উদ্দীপনা তেমন ছিল না।তবে তার মা-বাবাই উৎসবের ছোঁয়া দিত কখনও অনেক আয়োজনে, কখনও দীনতায়। মায়ের হাতের পায়েস থাকত স্বচ্ছলতায়- দীনতায়ও। বৈশাখ মাসে ঢাকা গেলে বাবা তরমুজ নিয়ে আসতেন। তাদের ছোট শহরে তখন তরমুজের এত রমরমা ছিল না । ঢাকার তরমুজের ভিতরটা থাকত টকটকে লাল এবং চিনির মত রোয়া। অস্বচ্ছলতা থাকলে মা তার স্কুল শেষে ছোট তরমুজ নিয়ে আসতেন। বাসার সামনে রিক্সা থামলে, রিক্সাওয়ালাকে অনুরোধ করতেন তরমুজটা একটু এগিয়ে দিতে। আর কখনও কখনও রিক্সার বেল শুনে ছেলে-মেয়েরা এগিয়ে যেতো।

সে বেলায় পহেলা বৈশাখ তেমন রঙ্গিন ছিল না । তার শিক্ষিকা মা চৈত্র সংক্রান্তিতে ঘর পরিষ্কার করতেন। পহেলা বৈশাখে শহরের প্রান্তে মেলা বসবে - এটাই ছিল নতুন বছরের আগমন বার্তা । সে মেলা তেমন রঙিন ছিল না। নিত্য প্রয়োজোনীয় দা-বটি, হাড়ি-কুড়ি সেইসঙ্গে মাটির খেলনা, মুড়ি-মুরকি, মিষ্টি, জিলাপী। মাটির পুতুল, হাতি, ঘোড়া। হাড়ি-পাতিলে রঙ্গিন নকশা করা থাকত। মেলায় তেমন যাওয়া হয়েছে বলে মনে পড়ে না । তবে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখের পরে দাদু গ্রাম থেকে নিয়ে আসতেন মিষ্টি - সাদা সাদা হাতি, ঘোড়া, মাছ, মুরগী । মিহি চিনির তৈরী । কি সুন্দর সেগুলি দেখতে। ভীষন সাদা । কামড়ে, কামড়ে খেয়়ে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করত না। জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে খাওয়া হত, যতক্ষণ এই সুন্দর খেলনা মিষ্টিগুলি বাঁচিয়ে রাখা যায়। ওগুলিকে খেলনা মিষ্টিই বলা হোত।

এখন রাজধানীর রমনার চৈত্র-সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ অনেক রঙিন । ক্রমেই সে রং ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত রাজধানী জুড়ে - রাজধানী ছাড়িয়ে গ্রামগঞ্জেও। উৎসব ঘিরে বিকিকিনি হবে, বানিজ্য হবে, কোলাহল হবে । আগে পহেলা বৈশাখ মেলা ছিল নিছক সাদামাটা। এখন অনেক রঙিন । মন্দ নয়। তবু আশঙ্কা হয় এই বাণিজ্যিক পহেলা বৈশাখ তথা কর্পোরেট আয়োজন চিরন্তন পহেলা বৈশাখের নির্মল আনন্দকে গ্রাস করে ফেলতে পারে।

এ যুগের মা ভাবেন, তার মা-বাবা কি এই রঙিন পরিবর্তন মেনে নিতেন! নিশ্চয় নিতেন। তারা দুজনেই ছিলেন রঙিন মনের মানুষ, নতুনের প্রতি আগ্রহী। মা বৈশাখের এ রং মেখে নিতেন অথবা মনের গহিনে খুশি হয়ে রঙিন ভেলায় ভাসতেন। সাংস্কৃতির কোন অঙ্গনেই তার পদ চারনা ছিল না, কিন্তু আগ্রহ ছিল পূর্ণমাত্রায়। অনেক ব্যস্ততা, ক্লান্তির পরেও শহীদ মিনারের চত্বরে খোলা আকাশের নিচে পরিবারের সবার সঙ্গে অনেক রাত অবধি অনুষ্ঠান দেখে উৎফুল্ল হতেন। উচ্ছসিত প্রশংসা করতেন। হেসে হেসে বলতেন 'অনন্ত হীরা' র পারফরমেন্স কিযে ভালো লাগে। তখন পহেলা বৈশাখে কোন রঙিন আয়োজন হোত না। রমনার রঙিন উৎসব দেখলে নিশ্চয় আনন্দে আত্মহারা হতেন। মায়ের সে আনন্দ আর করা হয়ে ওঠেনি । মা চলে গেলেন অকালে না ফেরার দেশে।

সাতাশ বছর আগের এক পহেলা বৈশাখ। মা কে হারিয়ে বাবা তখন মনজগতে একা । পহেলা বৈশাখের দুদিন আগে এসেছেন রাজধানীতে। বড় বোন আর ছোট বোন সেজেগুজে রমনায় গেলেন বাবাকে নিয়ে। বাবা পড়লেন পাঞ্জাবী মহাউৎসাহে। রমনার বটমূলে তখন ছায়ানটের যন্ত্রীরা তাদের সুরের যন্ত্রে কেবল টুংটান আওয়াজ তুলছেন। ততক্ষণে সেথা “ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী”।

বাবা, যার গানের সাথে নিত্য দিনের বসতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে যিনি ক্লান্তি দূর করতেন, সারাক্ষণ গুনগুন করেন যিনি, তিনি বছর শুরুর সূর্যের উকি দেওয়া ভোরে , মৃদুমন্দ বাতাসের দোলনায় দুলে সানজিদা খাতুনের কণ্ঠ সৈনিকদের সমবেত গান তন্ময় হয়ে শুনছেন -“দারুন অগ্নিবানে রে, হৃদয় তৃষায় হানেরে” ভরাট গলায় আবৃত্তি- “হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি! জগত আসি সেথা করিছে কোলাকুলি!”

ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ করা গেল না । চারুকলার মঙ্গল শোভা যাত্রা দেখার তাড়া । মধ্যে কিছুক্ষণ শিশু পার্কের সামনে দাড়িয়ে ফকির আলমগীরের গান শোনা । শোভাযাত্রা শেষ করে যেতে হবে টি এস সি তে বয়াতিদের গান শুনতে। আব্দুর রহমান বয়াতি, কাঙ্গালীনি সুফিয়া তখন ছাত্রনেতাদের নাম ধরে ধরে গান গাইতেন | চারুকলার কয়েকধাপ আগেই ফুলের সমাহার। দুই বোন পরস্পরের খোপায় ফুল পরিয়ে দিল। বাবা চেয়ে চেয়ে দেখে হাসলেন। ছবি তোলার কোন সুযোগ ছিল না । বাবা আর মেয়েদের হৃদয়ে ছবি রয়ে গেছে অমলিন । ঢাক ঢোল বাজিয়ে, বড় বড় পশু,পাখী, রঙিন প্রজাপতি, রাজা-রানী নিয়ে ততক্ষেণে মঙ্গল শোভা যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে। শুধু চারুকলা নয়, তাদের সাথে তখন যোগ দিতেন ঢাকার প্রায় সব সেলিব্রেটি। বাবা খুশীতে আত্মহারা । সারা জীবন সাংস্কৃতির সঙ্গে থেকেও এমন রঙিন উৎসবে তিনি যোগ দেননি কখনও। ভীড় তখন উপচে পড়ছে। তাদের তিন জনের সঙ্গ প্রায় ছিন্ন হবার উপক্রম। বাবার সঙ্গে মেয়েদের সব ব্যাপারে গল্প হতো, কিন্তু আদর দেয়া নেয়া ব্যাপারটা ছিল না । কখনও বাবা আদর করে সন্তানদের জড়িয়ে ধরেননি, মেয়েরাও কখনও বাবার ঘাম মুছিয়ে দেয়নি। মেয়েরা দেখল রঙ্গিন পহেলা বৈশাখের রঙ্গিন মহিলাদের ভীড় ঠেলে বাবা আগাতে পারছেন না। বড় মেয়েটি বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। বড় মেয়ের হাত ধরে ভীড় থেকে বাবা নিজেকে যেন মুক্ত করলেন। বাবা, মেয়ে দুজনেই কি মনে মনে ‘রবি ঠাকুর’ আবৃত্তি করল -

"আমি ছিলাম ছাতে
তারায় ভরা চৈত্রমাসের রাতে।
হঠাৎ মেয়ের কান্না শুনে, উঠে
দেখতে গেলেম ছুটে ।
সিঁড়ির মধ্যে যেতে যেতে
প্রদীপটা তার নিবে গেছে বাতাসেতে।
শুধাই তারে, “কী হয়েছে, বামী। ”
সে কেঁদে কয় নিচে থেকে, “হারিয়ে গেছি আমি। ”

করবী মালাকার


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

লেখার শিরোনাম পড়েই মনে হল, এটা আপনার লেখা হতে পারে। মিলে গেছে। হাসি

লেখা ভালো লেগেছে। মনোযোগী পর্যবেক্ষণ, মন ভাল করা সহজ সরল উপস্থাপন। লেখার শেষের ছোট্ট মোচড়টিও সুন্দর।

সারা পৃথিবী জুড়েই সম্ভবতঃ উৎসবগুলি আরো রঙ্গিন আরও বাণিজ্যিক হয়ে উঠছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

করবী মালাকার এর ছবি

আমার মন ভাল করল আপনার সুন্দর মন্তব্যটি । আমি আমার প্রদীপটি জ্বালিয়ে নিলাম। শ্রদ্ধা

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

হ্যাঁ, পয়লা বৈশাখ এখন অনেক রঙ্গীন হয়েছে, দিন দিন আরও রঙ্গীন হয়ে উঠছে।

সৌরভ এর ছবি

ভালো লাগলো।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।